রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

প্রতিবেশী : মোদীযুগের কেলি-কাহিনী

ওয়ারিস রব্বানী

মোদীর বিজেপি এখন ভারতের ক্ষমতায়। আহা! কত সুখে এখন ভারতের উগ্র হিন্দুরা! পাশাপাশি এদেশের সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের মুখেও ঢেকুরের অভাব নেই। এর মধ্যে অবশ্য একশ্রেণীর অতি সরল মুসলমান মনে করে বসেছিলেন, মোদী মসনদে এলে এ দেশের মসনদেও যায়-ঝাক্কি কিছু একটা যাবে। কংগ্রেসের বন্ধুদের প্রতি বিজেপি ঝাল মেটাবে। বোকামি পর্যায়ের এই উদগিরিত সারল্য এখন অনেকেই কষ্ট করে আবার গিলে ফেলছেন। কারণ মোদীর আগমনে এ দেশের হালবদলের কিছু তো ঘটেইনি; উল্টো ভারতে ঘটে চলেছে নানান ধরনের আদিম ও হিংসাত্মক কাণ্ড-কারখানা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরপরই বিভিন্ন প্রদেশে আচমকা কিছু নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রদেশে সুচতুর সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া হয়েছে। ঘরওয়াপেসির নামে জোর করে, প্রচার করে উগ্রশক্তি কোথাও কোথাও কিছু গরিব মুসলমানকে হিন্দুত্বে দীক্ষা দেওয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছে। উপরন্তু এমন ঘটনা সারা ভারতেই ঘটাবে বলেও তারা ঘোষণা দিয়েছে। গরু নামক দেবতাকে বাঁচানোর জন্য গো-হত্যার সঙ্গে দশবছর কারাবাস থেকে রাজ্যভেদে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও বলবৎ করেছে। ভগবানের জীবন রক্ষা বলে কথা!

এই মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে আরেক উৎপাত। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আসামের গুয়াহাটিতে গিয়ে বিজেপি-নেতা সুব্রানিয়াম স্বামী বলেছেন, মসজিদ কোনো ধর্মীয় স্থান নয়, তাই ইচ্ছা হলেই গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। হায়রে উর্বর মগজধারী! ধর্মীয় স্থান মনে না করলেও এতটুকু তো বোঝার কথা ছিল, কারো অনুমতি ছাড়া তার বসতবাড়ি এমনকি গ্যারেজ-বারান্দাও গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না। কী আর করা! গরু-পুজারীর মগজ কি ছাগলের চেয়ে উপরে উঠবে!

বিজেপির জিগরি বন্ধুর তো অভাব নেই। ভারতের যত উগ্র, সশস্ত্র ও জঙ্গি হিন্দু দল আছে- সবকটির সঙ্গেই বিজেপির অন্তরের মাখামাখি। সেরকম একটি দল শিবসেনা। সেই শিবসেনার নেতা সঞ্জয় রাউত মধ্য এপ্রিলের শুরুতে এক প্রবন্ধে দাবি করেছেন, ভারতের মুসলমানদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে হবে। তিনি নাকি মুসলিম জনতার প্রতি দরদ নিয়েই এ-জাতীয় দাবি করেছেন। প্রয়াত বালঠাকরের দল শিবসেনা। এরা ভারতজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষ রক্তপাত ঘটানোর মহা কারিগর। ঝামেলা তো এখানেই শেষ নয়। এর দুদিনের মধ্যেই আরেক উগ্র সংগঠন-হিন্দু মহাসভার শীর্ষ নেত্রী সাধ্বী দেবা ঠাকুর দাবি করেছেন, মুসলিম-খ্রিস্টানদের জোরপূর্বক নির্বীজকরণ করা উচিত। হিন্দু নেত্রী ভারতে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সংখ্যাবৃদ্ধি রুখে দেয়ার জন্য এ দুটি ধর্মের পুরুষদের বিশেষাংগে অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন। আর হিন্দুদের প্রতি তার আহ্বান, অধিক সন্তান জন্মদানের। হিন্দু ধর্মীয় নেত্রী এই সাধ্বীর বক্তব্যে ভারতজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। তার আরেকটি দাবি,দেব-দেবীদের মূর্তি মসজিদ ও গির্জায় বসাতে হবে।

ধর্মপ্রাণ এই হিন্দু মহিলা শেষ পর্যন্ত অপর ধর্মের পুরুষদের বিশেষ জিনিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন! হিন্দু জনসংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ তো তিনি অন্যভাবেও দূর করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। তার সম্প্রদায়ের পুরুষদের মধ্যে তার আদর্শের কয়েক কোটি সাধ্বী মহানব্রত নিয়ে কয়েক বছর বসবাস করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এটা তো সহজ রাস্তা। অন্য ধর্মের পুরুষদের ... প্রতি তার মনোযোগ দেওয়ার কোনো দরকারই নেই। আসলে বৈরাগীর মাথা যদি নষ্ট হয় তাহলে নাকি সর্বনাশ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম এতে মোটেও উৎসাহ হারায়নি। সাম্প্রদায়িক সুরসুরি তারা সবাই সমান পছন্দ করে।

দুঃখ আরেক জায়গায়। এই যে,মোদীযুগের ভারতে কত রকম সাম্প্রদায়িক কেলি চলছে,এদেশের পাকিস্তান-চটকানো মৌলবাদবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকরা তাতেও নীরব। দালাল, আত্মাবিক্রিকারী গণমাধ্যম কর্তারা এখন কি তাহলে ভেতরে ভেতরে গণদুশমন? এরা কি তবে মুসলিম উৎখাতকামী, হিন্দু-অনুরাগী একটি গণমাধ্যমের জাল বিছিয়ে মানুষের মগজ ধোলাই করতে চায়? ভারতের কাণ্ড আর এ-দেশের গণমাধ্যমের মুখ একসঙ্গে দেখলে এমনটিই তো মনে হয়। তবে এই সমর্পিত দালালির ফল ভালো হওয়ার তো কথা নয়। চিন্তা, অবস্থান ও সততার বিচ্যুতি দেখে একশ্রেণীর চেতনাধারী গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষ এখন অন্যরকম দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। এর ফলে অচিরেই গণমাধ্যম কর্তৃক মগজধোলাইয়ের পরিবর্তে জনগণ কর্তৃক অন্য কিছু শুরু হয় কি না-বলা খুবই মুশকিল।

 

 

advertisement