রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

বিশ্বাস : বিজ্ঞানমনস্ক সাম্প্রদায়িকতা !

আবু তাশরীফ

এখন আর কোনো রাখঢাক করা হচ্ছে না। ঘটনা স্বীকার করা হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই স্বীকৃতির পক্ষে জোরালো সাফাই-ও তুলে ধরা হচ্ছে। আগে বলা হত, ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে না। সে রকম কিছু লেখার প্রমাণ নেই। বলা হতো, ফেইসবুকে রাসূল-অবমাননার গুজব ছড়িয়েছে। বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন আর এটা বলা হয় না। ব্লগারদের ইসলাম-বিদ্বেষকে বরং এখন স্বীকৃতিই দেয়া হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে আস্কারা ও উস্কানি। আর এই স্বীকৃতি, আস্কারা ও সাফাইয়ের দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়েছে গণমাধ্যমের কর্তা ও ক্ষমতাদর্পী সুশীলরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও। এটা একদিক থেকে সত্য-স্বীকার। আরেক দিকে ভয়ংকর ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা। কারণ এরা এই সত্য স্বীকারে কোনো অনুতাপ তো করছে না। করছে আরো সিনাজুরি এবং ইসলাম-বিদ্বেষের বিষয়ে গুয়ার্তুমি। এতে অবশ্য এতদিন যাবত চলে আসা মহল বিশেষের ছলচাতুরির নেকাবটা উন্মোচিত হয়ে গেছে।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শাহবাগ-মঞ্চের চরম ইসলাম ও রাসূল-বিদ্বেষী এক ব্লগার-রাজিব নিহত হয়। দুদিনের মাথায় তার অকল্পনীয় ইসলাম ও রাসূল-বিষোদ্গারমূলক লেখাগুলো কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। দেশব্যাপি বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে। ক্ষোভ ও যন্ত্রণায় মানুষ ফুঁসে ওঠে। কিন্তু তখন সাবেক কমু এবং কট্টর সেকু সম্পাদক-সাংবাদিকদের গণমাধ্যমে পাপিষ্ঠ রাজিবকে ধর্মবিদ্বেষ-মুক্ত নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়। আর তার শত শত ব্লগ ও পোস্টের স্ক্রীনশটগুলোকে অস্বীকার করে বলা হয়- সে ধর্মবিদ্বেষী ছিল না। এগুলো তার বিপক্ষে বানিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। নাস্তিক রাজিবের অদ্ভুত পদ্ধতির জানাযাও দেয়া হয় শাহবাগ চত্বরে। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে আখ্যা দেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী। এরপর সেই রাজিবের রূহের মাগফিরাত ও দরাজাত বুলন্দির জন্য ঢাকার মসজিদে মসজিদে দুআ করানোর সন্ত্রাসী অভিযান চালানো হয়। এ যুগের আবু জেহেল ধিকৃত রাজিবের রাসূল-বিষোদ্গার নিয়ে মসজিদে কথা বলতে চাইলে বহু বহু ইমাম-খতীবকে অপমান করা হয়। মসজিদ কমিটিতে অবস্থান নেয়া নাস্তিকবান্ধব ব্যক্তিরা ইসলামবিদ্বেষী রাজিবের জন্য মসজিদকে না-পাক করে তোলার ঘৃণ্য চেষ্টা করে। আর এর সবই করা হয় ব্লগে রাজিবের বীভৎস-নোংরা ইসলামবিরোধী বিষোদ্গারগুলো অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। গণবিরোধী গণমাধ্যম আর ক্ষমতাদর্পীদের ভাবখানা ছিল, রাজিব যেন পাক্কা মুসলমান। এরপর দেশ অনেক ঝড়-বন্যা পার করেছে। এখনও দেশ সেই অন্ধ মানসিকতার গণমাধ্যম ও নাস্তিক বান্ধব লোকদের হাতেই আবদ্ধ আছে। এভাবে প্রায় দুবছর আরো পার হয়ে গেছে।

এবছর ফেব্রুয়ারির শেষে আরেকজন হাই প্রোফাইল নাস্তিক ব্লগার অভিজিত রায় নিহত হয়। তার ব্লগ ও পোস্টগুলোতেও তীব্র ইসলাম ও রাসূল-বিদ্বেষের বহু প্রতিভা বিদ্যমান। প্রিয় রাসূলের চরিত্র হননমূলক লেখায় সে মোটেই পিছিয়ে ছিল না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই কথিত নাস্তিকের রাসূল-অবমাননার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সে শুধু নাস্তিক ছিল না- সে ছিল আপাদমস্তক এক হিংস্র সাম্প্রদায়িক। নিজের গড়া মুক্তমনা ব্লগসাইটের কাজই ছিল বিজ্ঞানমনস্কতার নামে, মুক্তচিন্তার নামে তীব্র ভয়ংকর ইসলাম-বিদ্বেষ ও ইসলাম-অবমাননা। সে নিহত হওয়ার পরেও একজন-দুজন জ্ঞানপাপী প্রতারক বলার চেষ্টা করেছেন-সে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখত। সে তো ধর্মের বিরুদ্ধে লিখত না। (বিবিসি সংলাপ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ # মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশীদের বক্তব্য। নিউজকপি ১ মার্চ ১৫ নতুনবার্তা) তবে বেশিরভাগ নাস্তিকবান্ধব কীর্তিমানেরা বলেছেন সরাসরি কথা। অভিজিত রায়কে নাস্তিক (সে যে ইসলাম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক-সে কথা বলা হয় না) স্বীকার করে নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ওই বিবিসি সংলাপেই বলেন-বাংলাদেশে আস্তিক-নাস্তিক সবাই অবস্থান করতে পারবে। এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। উপদেষ্টা মহোদয় ওই অনুষ্ঠানে অভিজিত রায়কে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে প্রশংসা করেন। আর ঠিক এর এক সপ্তাহ পর ৬ মার্চ -১৫ খুলনার এক অনুষ্ঠানে তিনিই বলেন, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে অর্থাৎ মুক্তমনের অধিকারী হতে হবে। দেখুন! কত সাফ সাফ কথা তার। কে বলতে পারবে, রাসূল-বিদ্বেষী পাপিষ্ঠ ব্লগারদের প্রতি দরদী পৃষ্ঠপোষকতায় উপদেষ্টাদের মাঝে কোনো দ্বিধাদ্বদ্ব রয়েছে? আসলে ওই ধাঁতের মানুষই তারা নন। অবশ্য দয়া করে এবার অভিজিত রায়ের জন্য মসজিদে মসজিদে দুআ করানোর কোনো হুকুম জারি করা হয়নি। এই অভিজিত রায়কে আবার প্রভাবশালী কেউ কেউ শহীদ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার উদারতাও দেখিয়েছেন। তবে সে কততম (দ্বিতীয় নাকি তৃতীয়) মুক্তিযুদ্ধের শহীদ- সেটা অবশ্য কেউ উল্লেখ করেননি।

অভিজিত রায়ের অধ্যায় সামনে আসার পর অনেকেই বলেছেন, এই শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক-নাস্তিকের প্ররোচনাতেই হিন্দু-বৌদ্ধ তরুণদের মধ্যে নাস্তিক্যের ছদ্মাবরণে উগ্র ইসলামবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক একটি প্রজন্ম গত ৭/৮ বছরে গড়ে উঠেছে। এ জন্য গত কয়েক বছরে বিভিন্ন স্কুলে হিন্দু শিক্ষকের বক্তব্যে, ফেইসবুকে হিন্দু-বৌদ্ধ তরুণদের স্ট্যাটাসে/পোস্টে তীব্র ইসলাম-বিদ্বেষের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বর্তমানেও বিভিন্ন ব্লগে এর বিস্তর নজির পাওয়া যায়। বিশেষত বিভিন্ন মিডিয়াসাইটে (প্রথম আলো, বিডি নিউজ, ডয়েচে ভেলে এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার ইত্যাদি) প্রকাশিত ব্লগ ও সংবাদের নিচের মন্তব্যে হিন্দু-বৌদ্ধ আইডি থেকে যেসব ইসলাম বিদ্বেষী কুৎসিত সাম্প্রদায়িক বক্তব্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়- সেগুলোও লক্ষণীয়। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, সেগুলো বিজ্ঞানমনস্কতা বা মুক্তমনা নাস্তিক্যবাদের কোনো নমুনা বহন করে না। বরং সেগুলো হচ্ছে উগ্র চরিত্র হননমূলক রাসূল-অবমাননার খোলামেলা সাম্প্রদায়িক মহড়া। নাস্তিক-সহনুভূতিশীল ইসলামবিদ্বেষী গণমাধ্যম এবং ক্ষমতাবাদী গোষ্ঠী এসব এখন আর ছাইচাপা দিয়ে ঢাকারও দরকার মনে করে না। বরং উঁচু স্বরে তারা এসবের পক্ষেই নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।

একই নমুনা পাওয়া যায় গত ৩০ মার্চ নিহত ব্লগার ওয়াশিকুরের ব্যাপারেও। ইসলাম বিদ্বেষ ও রাসূল অবমাননায় সে-ও কম যায়নি। লক্ষীপুরের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার আবার জানাযাও দেয়া হয়েছে। অদ্ভুত এক তামাশা! এদের আবার জানাযা দিতে হয়! অথচ এই নিহত প্রত্যেকেই এবং এদের অনুসারী ও সহমতের সবাই প্রচলণ্ড ইসলামবিদ্বেষী। নবীজীর চরিত্রে কালিমালেপনকারী। ইসলামের প্রকাশ্য ধ্বংসকামী নাস্তিক। সাধারণভাবে দুনিয়াজুড়ে নাস্তিক বলতে যা বুঝানো হয়- তার চেয়ে শতগুণ বিদ্বেষী ও হিংস্র নাস্তিক এরা। এমন খিস্তিবাদী, উগ্র, সাম্প্রদায়িক ও উদ্ভট নাস্তিক সম্ভবত দুনিয়ার আর কোথাও নেই।

তো এদের পক্ষ নিয়েই মতপ্রকাশের কথা জোরেশোরে বলা হয়। এদের পক্ষ নিয়েই মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্কতা আর স্বাধীনতার কথা বলা হয়। এদেরই অন্ধ-সাম্প্রদায়িক ইসলামবিদ্বেষী নোংরামিগুলোকে চলতে দিতে হবে- দাবি করা হয়। সাবেক ও বর্তমান কমুনিস্ট-সেক্যুলার ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে বসে, সুশীলের চেয়ারে বসে এসব দাবি এখন প্রকাশ্যেই তুলছে। অবশ্যই এসব নরকের কীট এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গুরুদের ব্যাপারে আইন হাতে তুলে নিতে আমরা কাউকেই উৎসাহিত করতে পারি না। আইনের চোখে এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য। তবে, আমরা একথা তো হৃদয় দিয়ে বলতেই পারি, বিশ্বাসী মুসলমান- নবীপ্রেমিক! যারা যে পর্যায়ে আছি (আলেম, চিকিৎসক-প্রকৌশলী কিংবা শিক্ষক-ছাত্র-চাকুরিজীবী-ব্যবসায়ী এবং কৃষক-শ্রমিক) আসুন! ইসলাম বিদ্বেষী, নবীজীকে আঘাতকারী, সাম্প্রদায়িক শয়তানচক্রকে দেশজুড়ে প্রতিরোধ করি। খুনিকে যেভাবে প্রতিরোধ করা উচিত, ধর্ষক, লুটেরা ও লুচ্চা-লম্পটদের যেভাবে প্রতিরোধ করা উচিত- এদেরও আসুন সেভাবেই প্রতিরোধ করি। এদের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল, যারা এদের পৃষ্ঠপোষক, তাদেরকেও চ্যালেঞ্জ করি। কারণ, ইসলাম-পালন আমাদের অধিকার। নবীজীর প্রতি ভালোবাসা আমাদের অঙ্গীকার। কোনো শয়তান কিংবা শয়তানচক্রের নষ্ট খেয়ালের কাছে এই অধিকার ও অঙ্গীকার আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না। 

 

 

advertisement