রবিউল আখির ১৪৩৬   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অসত্য কথন : প্রকাশ, পরিণাম ও মুক্তির উপায়

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

 ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, মানবের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, সত্যবাদিতা। এ ছাড়া একজন মুমিন কামিল মুমিন হতে পারে না। একজন মানব পূর্ণাঙ্গ মানব হতে পারে না। আরবীতে এর প্রতিশব্দ الصدق। কুরআন মাজীদে ও হাদীস শরীফে এ বিষয়ে খুব তাকীদ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর সত্যবাদীদের শামিল হও।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ১১৯)

ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর সহীহ বুখারীর আদব-অধ্যায়ে এই আয়াতটিকে শিরোনাম বানিয়েছেন। তাঁর শিরোনাম- باب قول الله تعالى : يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين وما ينهى من الكذب অর্থাৎ, ‘প্রসঙ্গ- কুরআন মাজীদের আয়াত

يا يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

আর ইসলামী শরীয়তে যা নিষেধ অর্থাৎ মিথ্যা।’ এককথায়, সত্য-মিথ্যা-প্রসঙ্গ।

এই শিরোনামে ইমাম বুখারী রাহ. তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। সত্যবাদিতার গুরুত্ব ও মিথ্যার পরিণাম সম্পর্কে প্রথম হাদীসটি হচ্ছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত একটি বিখ্যাত হাদীস, যা সহীহ বুখারীতেও আছে, সহীহ মুসলিমেও আছে। আমি এখানে সহীহ মুসলিমের পাঠ উল্লেখ করছি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

عليكم بالصدق، فإن الصدق يهدي إلى البر وإن البر يهدي إلى الجنة، وإن الرجل يصدق ويتحرى الصدق حتى يكتب عند الله صديقا

 ‘তোমরা সত্যকে অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো কাজে উপনীত করে। আর ভালো কাজ উপনীত করে জান্নাতে। মানুষ সত্য বলে ও সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকে, একপর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।’

 এ হল হাদীসের প্রথম অংশ, দ্বিতীয় অংশ-

 وإياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وإن الرجل يكذب ويتحرى الكذب حتى يكتب عند الله كذابا.

‘আর মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা উপনীত করে পাপাচারে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬০৭)

তো এ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যকে অবলম্বন করার এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকার তাকীদ করেছেন। এজন্য সত্য বলা ফরয। মিথ্যা বলা হারাম।

আর যে কোনো চিমত্মাশীল মানুষ উপলব্ধি করেন যে, সত্য বলা মানুষের একটি উৎকৃষ্ট গুণ আর মিথ্যা বলা একটি নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য। ভালো মানুষ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। একজন ভালো মানুষ সবসময় সত্য বলেন। তো সত্য বলা ধর্মীয় দৃষ্টিতে যেমন ফরয তেমনি বুদ্ধির দিক থেকেও এক উত্তম ও অপরিহার্য মানবীয় বৈশিষ্ট্য। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সত্যবাদিতার কোনো বিকল্প নেই। ইসলাম যেহেতু ‘দ্বীনে ফিতরত’ তাই এখানে সত্যবাদিতার গুরুত্ব অপরিসীম।

সত্যবাদিতা ঈমানের শাখা

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উসত্মায ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ রাহ. এবং পরবর্তী মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকী রাহ. হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর একটি বাণী সহীহ সনদে উলেস্নখ করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. বলেন-

إياكم والكذب فإنه مجانب الإيمان

‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক, কারণ মিথ্যা ঈমানের পরিপন্থী।’ -আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ২৬১১৫

সুতরাং যে মিথ্যা বলে সে কামিল মুমিন নয়।

হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

يطبع المؤمن على كل شيء إلا الكذب والخيانة

অর্থাৎ মুমিনের মধ্যে স্বভাবগত বিভিন্ন দোষত্রুটি থাকতে পারে। إلا الكذب والخيانة তবে সে মিথ্যুক ও প্রতারক হতে পারে না। -আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩০৯৭৫

তো মিথ্যা ইসলামের দৃষ্টিতে অতি গর্হিত, অবশ্য-বর্জনীয়।

মিথ্যাবাদিতা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য

কুরআন মাজীদে সূরাতুল বাকারায় আল্লাহ পাক মুনাফিকদের যেসকল বৈশিষ্ট্য উলেস্নখ করেছেন এর মধ্যে নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য হিসেবে উলেস্নখ করেছেন মিথ্যা বলাকে। আল্লাহ পাক বলেন-

وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

অর্থাৎ ‘তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। একারণে যে, তারা মিথ্যা বলত। মিথ্যায় অভ্যস্ত ছিল।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১০)

এখানে كَانُوا শব্দের তাৎপর্য আছে। كَانُوا শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যস্ততা বোঝায়। তো كَانُوا يَكْذِبُونَ এর অর্থ দাঁড়ায়, তারা ছিল মিথ্যায় অভ্যস্ত।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শরীফেও -যা ইমাম বুখারী রাহ. এ শিরোনামে এনেছেন- এই বিষয়টি পাওয়া যায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- آية المنافق ثلاث ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি।’ إذا حدث كذب ‘যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে।’ কথা বললেই মিথ্যা বলে। অর্থাৎ মিথ্যা বলা তার স্বভাব। মিথ্যায় সে অভ্যস্ত। তাহলে কুরআন মাজীদের بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ শব্দ থেকে এবং হাদীস শরীফের إذا حدث كذب শব্দ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, মিথ্যাবাদিতা ও মিথ্যায় অভ্যস্ততা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য।

এখানে একটি বিষয় একটু বোঝার আছে। আর তা এই যে, একজন মানুষ কীভাবে অবিরাম মিথ্যা বলে। আর এ তো শুধু একজন মানুষ না, গোটা একটা শ্রেণী। গোটা মুনাফিক শ্রেণীর বেশিষ্ট্য كَانُوا يَكْذِبُونَ। গোটা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য إذا حدث كذب একটি গোষ্ঠী কীভাবে মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে যায়? কীভাবে তার এ অবস্থা ঘটে যে, সে মিথ্যাই বলতে থাকে। যখনই কথা বলে মিথ্যা বলে? আপাত চিন্তায় মনে হতে পারে, এহেন অধঃপতন তো খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের হতে পারে। যাদের বিবেক বলতে কিছু নেই। মিথ্যা বলে কিন্তু বিবেকের দংশনে দংশিত হয় না, এমন কিছু ইতরশ্রেণীর মানুষের এ অবস্থা হতে পারে, সমাজের এখানে সেখানে কিছু মানুষ এমন থাকতে পারে, কিন্তু গোটা একটা শ্রেণী, গোটা একটা সম্প্রদায়ের এ অধঃপতন কীভাবে ঘটে যে, তাদের উচ্চারণে মিথ্যারই প্রাবল্য, যখনই বলে সাধারণত মিথ্যাই বলে?! এই বিষয়টা  বোঝা দরকার।

এটা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদেরকে পরের আয়াতগুলো পড়তে হবে। পরের আয়াতে আল্লাহ পাক যা বলেছেন তা ওদের মিথ্যাচারের একেকটি দৃষ্টান্ত। আল্লাহ পাক বলেন-

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ، أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لَا يَشْعُرُونَ.

অর্থাৎ, ওদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে অনাচার করো না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী। জেনে রাখ, ওরাই অনাচার বিসত্মারকারী, কিন্তু ওদের চেতনা নেই।’ (সূরা বাকারা, ২ : ১২)

এখানে ঐ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। একটি সম্প্রদায়ের উচ্চারণ কীভাবে মিথ্যায় জর্জরিত হয়ে পড়তে পারে এর হাকীকত এখান থেকে বের হয়ে আসে। ওদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা পৃথিবীতে অনাচার করো না...। তাহলে কুরআন মাজীদ যে কাজগুলোকে ফাসাদ ও অনাচার বলছে ওরা ঐ কাজগুলোকেই বলছে  ইসলাহ ও শান্তি স্থাপন।

দেখুন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। শিরক বর্জনের আহবান করেছেন। নবুওত ও রিসালাতের সংবাদ দিয়েছেন। আখেরাতের সংবাদ দিয়েছেন। তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত এই তিন বিষয় হল তাঁর দাওয়াতের প্রধান বিষয়।

তো মুনাফিক শ্রেণী, যাদের অধিকাংশই ছিল ইয়াহুদী, ওরা তাওহীদের দাওয়াত অস্বীকার করেছে এবং পৌত্তলিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিরকের পক্ষাবলম্বন করেছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত ও রিসালাতকে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর অবমাননা করেছে। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে  যে বার্তা ও বিধান নিয়ে এসেছেন ওরা তা অস্বীকার করেছে। আর মানুষকে ইসলাম থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে। আল্লাহ পাক ওদের এই কার্যকলাপকে বলেছেন ফাসাদ ও অনাচার। আর একেই ওরা বলে, শান্তি স্থাপন। তাওহীদের দাওয়াতকে অস্বীকার করা এবং ইসলামের প্রচার, প্রসার ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা ওদের দৃষ্টিতে শান্তি স্থাপন।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে তাওহীদের দাওয়াত যখন এল তখন মুশরিক সম্প্রদায়ের সাথে বিরোধ হল, সংঘাত হল। মুশরিকেরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা.-কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেওয়া শুরু করল। একপর্যায়ে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে জিহাদের বিধান এল, অন্যায় প্রতিরোধ করার বিধান এল। তখন এই সকল বিষয়কেই মুনাফিকরা বলতে লাগল ফাসাদ। যেন ঐ সমাজে ইতিপূর্বে রক্তপাত ছিল না। হানাহানি ছিল না। যেন ঐ সমাজে ইতিপূর্বে নারীর অধিকার নষ্ট করা হত না। শিশু ও দুর্বলের অধিকার নষ্ট করা হত না। ইসলাম আসামাত্রই যেন রক্তপাত শুরু হল! হানাহানি শুরু হল! ইসলাম আসামাত্রই যেন অধিকার খর্ব করা শুরু হল! ইতিপূর্বে সব যেন, সবাই যেন ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে চলছিল!

তো আল্লাহ পাক বলেন, তোমরা অনাচার করছ। ওরা এর বিপরীতে বলে, আমরা তো শান্তি স্থাপন করছি! তাহলে ওদের এই উচ্চারণটা মিথ্যা। ওরা ‘ফাসাদ’কে বলছে ‘সালাহ’। অনাচারকে বলছে শান্তি। এটা ওদের মিথ্যার একটি নমুনা।

এটাকে যদি আরেকটু বিশ্লেষণ করি, তাহলে এখানে যা দেখতে পাই তা হচ্ছে, সংজ্ঞা পরিবর্তন। ওরা সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। কুরআন মাজীদ যেটাকে ফাসাদ বলছে, যা আসলেই ফাসাদ, বাস্তবেই অনাচার, শিরকের পক্ষাবলম্বন করা, রাসূলের অসম্মান-অবমাননা করা, মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা, ইসলামের পথ থেকে মানুষকে বিরত রাখা, সত্যের পথ থেকে, বিশ্বাসের পথ থেকে নিবৃত্ত করা, এই সব অনাচারকে তারা নাম দিয়েছে শান্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠা। সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তারা যখন শিরকের পক্ষাবলম্বনকেই বলছে শান্তি, ইসলামের বিরুদ্ধতাকেই বলছে শান্তি, রাসূলের অস্বীকার ও অবমাননাকেই বলছে শান্তি, যতবার তারা এই বিষয়গুলোকে শান্তি নামে আখ্যায়িত করছে, ততবার তারা মিথ্যা বলছে এবং যতবার শান্তির পক্ষের যুক্তিগুলো এখানে প্রয়োগ করছে ততবার মিথ্যা প্রয়োগ করছে। এভাবেই তাদের উচ্চারণে ও যুক্তি উপস্থাপনায় মিথ্যার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাচ্ছে। আর এ-ই যখন ওদের পরিভাষা, এ ভাষাতেই যখন ওরা কথা বলে তো ওদের কথা ও উচ্চারণ মিথ্যায় সয়লাব হয়ে য যাচ্ছে।

দেখুন, আমরা যখন কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করি তখন মনে হয় কুরআন মাজীদের আয়াতগুলো যেন আজকের জন্যই নাযিল হয়েছে। এখন আমরা মিথ্যার এই প্রকাশটাই তো চারদিকে দেখতে পাচ্ছি- সংজ্ঞার পরিবর্তন, পরিভাষার পরিবর্তন।

দৃষ্টান্ত হিসাবে সাম্প্রতিক প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে পারি। এই যে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ এই কথাটাই ধরুন। আমি একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে কটূক্তি করলাম, এটা কি মতপ্রকাশ? আমি একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে অবজ্ঞা করলাম, এটা কি মতপ্রকাশ? এটা তো অবজ্ঞা! অবমাননা! এটা তো অন্যায়-অনাচার! এই অন্যায়কে যখন আমি বলছি মতপ্রকাশ তো আমি অসত্য বলছি এবং যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যুক্তিগুলোকে অন্যায় অবমাননার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি তো আবারও অসত্য বলছি।

কিন্তু যারা এভাবেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত, যারা কটূক্তিকেও মনে করে মতপ্রকাশ, অবজ্ঞাকেও মনে করে মতপ্রকাশ তারা যতবার ‘মতপ্রকাশ’ শব্দটা এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন ততবার মিথ্যা বলেন এবং যতবার এ ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যুক্তিগুলোর অবতারণা করেন ততবার মিথ্যা বলেন। বুঝে বলুন আর না-বুঝে বলুন। ‘অসত্য’ না বুঝে বললেও অসত্য। আর বুঝে শুনে বললে তো সেটা হয় অসত্য এবং প্রতারণা। এভাবেই মিথ্যা তাদের উচ্চারণে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এভাবেই তাদের উচ্চারণ মিথ্যায় সয়লাব হয়ে যায়।

এ মনে করার সুযোগ নেই যে, মুনাফিকীর এ বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা শুধু ঐ যুগে ঐ সমাজেই ছিল, এ যুগে এ সমাজে নেই। আছে এবং ব্যাপকভাবে আছে; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো এই যুগ আগের সকল যুগকে মাত করে দিয়েছে।

আমাদের কর্তব্য

তো মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য, ঐসকল প্রবণতার বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং নিজ আচরণ-উচ্চারণকে পবিত্র রাখা। আমরা যেন ওদের ঐ সকল  পরিভাষা ব্যবহার না করি। ঐ পরিভাষাগুলো অন্যায়-অনাচারকে ঢেকে রাখার আবরণমাত্র। এতে যেমন আছে মিথ্যাচার তেমনি আছে প্রতারণা। আর এ দুটো এমন প্রবণতা যা একজন মুমিনের মাঝে থাকতেই পারে না।

সম্প্রতি ফ্রান্সে যে ঘটনা ঘটল ঐ পুরো ঘটনার মূল্যায়ন অল্প সময়ে সম্ভব নয়। আমি শুধু একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে তা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবজ্ঞা ও অবমাননা করে একাধিকবার কার্টুন ছাপার পর ওরা বলছে, এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এ কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী সঠিক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ অবজ্ঞার স্বাধীনতা নয়।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এক জিনিস, অবজ্ঞার স্বাধীনতা অন্য জিনিস। অবজ্ঞার স্বাধীনতা কাউকে দেওয়া যায় না। অন্যায়ের স্বাধীনতা, জুলুম-অনাচারের স্বাধীনতা কাউকে দেওয়া যায় না। মতপ্রকাশের অধিকার ইসলামে এক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। উপযুক্ত ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের প্রচন্ড অধিকার ইসলামে দেওয়া হয়েছে। তবে একই সাথে ঐসকল নীতি ও বিধানও দেওয়া হয়েছে যার ফলে অবজ্ঞা, অবমাননা ও মিথ্যাচারকে ‘মতপ্রকাশ’ বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আল্লাহ পাক যদি তাওফীক দান করেন তাহলে কোনো সময় মতপ্রকাশের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ইনশাআল্লাহ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।

আপাতত শুধু এ কথাটাই বলতে চাই যে, এখন প্রচার-প্রচারণার যে ধারা সেই ধারায় যেন আমরা মুসলিমরাও ভেসে না যাই। আমরা যেন বর্তমান সময়ের নেফাকী ভাষায় কথা না বলি। এ ভাষায় যতবার কথা বলা হবে ততবার মিথ্যাবাদী হতে হবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের হাদীসখানা আবার স্মরণ করি-

 إياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وإن الرجل يكذب ويتحرى الكذب حتى يكتب عند الله كذابا.

 ‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা মানুষকে পাপাচারে উপনীত করে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে।ব্যক্তি মিথ্যা বলতে থাকে, মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, একসময় সে আল্লাহর কাছে চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে লিখিত হয়ে যায়।’

মিথ্যা-বর্জনের উপায়

মিথ্যা আমাদের বর্জন করতেই হবে। কীভাবে বর্জন করব- এ দিকেও হাদীসে ইঙ্গিত আছে। আর তা হচ্ছে, সত্য বলার চেষ্টা করা এবং এ সংকল্প করা যে, আমি মিথ্যা বলব না, কোনো অবস্থাতেই না। আমি চেষ্টা করব সত্য বলার, সঠিক বলার। দেখুন, আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে বলেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا

‘ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর সঠিক কথা বল।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ৭০)

তাহলে আমাকে সাবধান হতে হবে, আমি যে কথাটি বলছি, তা সঠিক কি না, ন্যায়সংগত কি না। সঠিক হলে বলব, না হয় বলব না। একজন মুমিন যদি এই চেষ্টায় থাকেন সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকেন আর আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকেন তাহলে আল্লাহ পাক তাকে সত্যবাদিতার গুণ দান করবেন। আর যিনি তা লাভ করবেন তিনি তো এক মহা সম্পদ লাভ করবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন 

 

 

advertisement