রবিউল আউয়াল ১৪৩৬   ||   জানুয়ারি ২০১৫

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১৬

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

অন্যান্য বই

শাবান ও রমযান ১৪৩৫ হি. সংখ্যা থেকে নিয়ে গত সংখ্যা (মুহাররম ১৪ ৩৬ হি.) পর্যন্ত মোট পাঁচটি বইয়ের উপর পর্যালোচনা হয়েছে। যেমনটি আমি বলে এসেছি, আলোচ্য মত ও চিন্তাধারার সমর্থনে অনেকেই বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। আলেম-গরআলেম সকলেই এ নিয়ে যারপরনাই কসরত করেছেন। যেসব পুস্তিকা ও প্রবন্ধ পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে আমার কাছে এসেছে তার সংখ্যাও অনেক। প্রতিটির উপর পর্যালোচনার মত পর্যাপ্ত সুযোগ যেমন নেই, তেমনি তার বিশেষ দরকারও নেই। এখন পর্যন্ত যা কিছু লেখা হয়েছে তার আলোকে ঐ সব পুস্তিকা ও প্রবন্ধের যাবতীয় আপত্তিকর বিষয় ইনশাআল্লাহ বিজ্ঞ পাঠক নিরসন করতে পারবেন।

 

মুহাম্মাদ এনামুল হক আল মাদানীর পুস্তিকা

বেশ কয়েকজন বন্ধু বললেন, গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক জনাব মুহাম্মাদ এনামুল হক আল মাদানীর বইয়ের উপরও পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। তার বইয়ের নাম কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ এবং সালাফে সলেহীনদের বিশ্লেষণের আলোকে পৃথিবীব্যাপী একই দিবসে সিয়াম ঈদুল ফিতর আরাফা ঈদুল আযহা আশুরা পালন সম্পর্কিত সংশয় নিরসন। আমি বললাম, ভাই! তার বই সম্পর্কে তো তাদেরই পন্থী আলেম শায়খ মুস্তফা বিন বাহরুদ্দীন আল কাসেমী জবাব লিখেয়েছেন। যার নাম পৃথিবীব্যাপী একই দিবসে সিয়াম ও ঈদ পালন প্রসঙ্গ যা তাওহীদ পাবলিকেশন্স বংশাল থেকে যিলকদ ১৪৩০ হিজরীতে ছেপেছে। আগ্রহী পাঠক তা সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে পারেন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, এনাম সাহেবের এখানে এই বিষয়ের অন্যান্য পুস্তিকার চেয়ে অতিরিক্ত বা আলাদা কিছু নেই। অতিরিক্ত কিছু থাকলে সেটা হল ভুল ব্যাখ্যা ও অসংলগ্ন কথাবার্তা কিংবা বলি, বক্তব্য বোঝার দুর্বলতা। উদাহরণস্বরূপ এখানে শুধু বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠা থেকে মাত্র তিনটি উদ্ধৃতি সম্পর্কে কিছু আরয করছি:

১। শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আলউসাইমীন রাহ.-এর বই-পুস্তক এবং ফতোয়াসমূহে এই বিষয়টি খুবই সুস্পষ্টভাবে বারবার লেখা হয়েছে যে, তিনি দলীলের আলোকে উদয়স্থলের ভিন্নতাকে ফিকহী বিধানের ক্ষেত্রেও ধর্তব্য মনে করতেন। কিন্তু এনাম সাহেব শায়খ উসাইমীনের নামে অবলীলায় লিখে দিচ্ছেন:

শাহরি রামাযান গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘‘আর যখন রামাযান মাসের আগমন শরয়ীভাবে সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হল তখন সেক্ষেত্রে চাঁদ উদয়ের বিভিন্নতা বা চাঁদের বিভিন্ন স্থানের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম পালন করার হুকুম চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। চাঁদ উদয়ের বিভিন্ন মঞ্জিলের সাথে নয়’’। অথচ শায়খ উসাইমীন রাহ. এমনটা বলেননি। তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হল, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির সাক্ষ্য দেয়ার ভিত্তিতে নতুন চাঁদ দেখা যদি প্রমাণিত হয়ে যায় তখন চাঁদের মঞ্জিলসমূহের (তিথিসমূহের) গণনার নিরিখে একথা বলা যে, এখন পর্যন্ত চাঁদের জন্মই হয়নি কিংবা এখন পর্যন্ত তা দৃষ্টিগোচর হওয়ার অবস্থায় পৌঁছেনি, অতএব চাঁদ দেখতে পাওয়ার দাবি ভুল ... শায়খ বলছেন, এইসব আপত্তি গ্রহণ করা হবে না। শরীয়ত চাঁদের বিধান চাঁদ দেখা ও দেখার সাক্ষ্য পাওয়ার সাথে যুক্ত করেছে, চাঁদের মঞ্জিলসমূহের (তিথিসমূহের) হিসাব বা গণনার সাথে নয়। শায়খের শব্দগুলো লক্ষ্য করুন:

وإذا ثبت دخول الشهر ثبوتا شرعيا فلا عبرة بمنازل القمر، لأن النبي صلى الله عليه وسلم  علق الحكم برؤية الهلال، لا بمنازله، فقال صلى الله عليه وسلم : إذا رأيتم الهلال فصوموا، وإذا رأيتموه فأفطروا. متفق عليه

 (মাজালিসে শাহরি রামাযান, পৃ. ৩৮, তৃতীয় মজলিস)

তো কোথায় মানাযিলুল কামার (চাঁদের বিভিন্ন মঞ্জিল) আর কোথায় মাতালিউল হিলাল (নতুন চাঁদের বিভিন্ন উদয়স্থল)! এনাম সাহেব চাঁদের মঞ্জিল ও নতুন চাঁদের উদয়স্থল- এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারেননি। আর সেজন্যই শায়খের বক্তব্যে উল্লিখিত মঞ্জিলকে মাতলা ধরে নিয়ে সমস্ত বিষয়টাই গুলিয়ে ফেলেছেন। জানি না শায়খের বক্তব্যের এই বিকৃতি সাধনের কী দরকার ছিল?

২। ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় এনাম সাহেব এও লিখেছেন,

‘‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় চাঁদ উদিত হওয়ার কারণে তারিখের রদবদল হবে না। বরং তা নতুন চাঁদের প্রথম তারিখ হিসাবে গণ্য হবে। তাই তাঁর আদর্শ সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।’’ (ইরয়ায়ূল গালীল, ৯০২ পৃষ্ঠা)

ইরয়ায়ূল গালীল টা কোন কিতাব এবং কার লিখিত, তা আমাদের জানা নেই। সম্ভবত কারুরই জানা নেই। লেখকের সঙ্গে একসূত্রে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, এটা শায়খ আলবানীর কিতাব। শুনে বিস্মিত হলাম। শায়খ আলবানীর কিতাবের নাম إرواء الغليل ইরওয়াউল গালীলইরয়ায়ূল গালীল নয়। তাছাড়া এটি মোট আট খন্ডের কিতাব। সূচীপত্রের জন্য আলাদা এক খন্ড। আর নবম ও দশম খন্ড منار السبيل মানারুস সাবীল-এর জন্য, ইরওয়াউল গালীলে যেই কিতাবের (মানারুস সাবীলের) হাদীসসমূহের তাখরীজ করা হয়েছে। শায়খ আলবানী রাহ.-এর এই কিতাবের প্রত্যেক খন্ডে পৃষ্ঠা সংখ্যা সাড়ে চারশর কম। তাহলে এখানে ৯০২ নম্বর পৃষ্ঠা কোত্থেকে এল এবং কোন খন্ডে?

বস্তুত এ ধরনের কথা শায়খ আলবানীর কিতাব ইরওয়াউল গালীলে কখনোই নেই। লেখক এ ক্ষেত্রে পীড়াপীড়ি করলে বলব, আলবানীর আরবী ভাষ্য উদ্ধৃত করুন। ইনশাআল্লাহ তিনি এই কিতাবে এ ধরনের বক্তব্য দেখাতে পারবেন না। প্রশ্ন হল, এমন অমূলক উদ্ধৃতির ফায়েদা কী এবং এর দরকারই বা হল কেন?

৩। একই পৃষ্ঠায় তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘উম্মতের অধিকাংশ ফকীহর মত হল, পৃথিবীর কোন দেশের নতুন চাঁদ দর্শন সমস্ত ইসলামী বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। এ জন্য কোন দেশ বা শহরে চাঁদের প্রথম তারিখ হলে, অন্য দেশে যদি তার পরের দিন চাঁদ দেখা যায়- তাহলে শেষোক্ত দেশবাসী প্রথম সিয়ামটির কাযা আদায় করবে। এই মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ একমত।’’ (ইমাম মুনযিরী, মুখতাসার সুনানু আবূ দাউদ ৩/২২০ পৃষ্ঠা)

এই উদ্ধৃতিও ভুল। ইমাম মুনযিরীর মুখতাসারু সুনানি আবী দাউদে ৩য় খন্ডের ২২০ নম্বর পৃষ্ঠায় কিংবা অন্য কোথাও এই কথার উল্লেখ নেই। মুনযিরী রাহ. ও তার কিতাবের সঙ্গে এই ভুল উদ্ধৃতি জুড়ে দেওয়ার মতলব তাহলে কী?

যে বইয়ের এক পৃষ্ঠাতেই এত পরিমাণ ভুল কথাবার্তা সেই বই নিয়েও পর্যালোচনা করার দরকার আছে কি?

যাই হোক, আমি পর্যালোচনার এই ধারাকে আপাতত সমাপ্ত করতে চাচ্ছি। এখন শুধু এনাম সাহেবের মিতা আরেক ভদ্রমহোদয় জনাব ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হকের বই নিয়ে কিছু কথা বলে বিদায় নিতে চাচ্ছি।

এক মুরুব্বি বললেন, মাওলানা আতাউল্লাহ ডায়রভী -এর বই, -জনাব কামাল আহমাদ যার অনুবাদ করেছেন- তার উপরও পর্যালোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু, যতক্ষণ পর্যন্ত সরাসরি মূল উর্দূ বইটি হসত্মগত না হচ্ছে ততক্ষণ শুধু তরজমার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা উচিত নয়।

অনূদিত বইটি আমি মোটামুটি নেড়েচেড়ে দেখেছি। লক্ষ্য করলাম, এর মৌলিক কথাবার্তার জবাব আমাদের প্রবন্ধে এসে গেছে। ভুল-বিচ্যুতি বলুন কিংবা ভুল বর্ণনা- সেটা এখানেও আছে। যেমন এক জায়গায় লেখা হয়েছে, হেদায়া ইত্যাদির আসল রচয়িতাগণ একথাই বলেছেন যে, ‘‘সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’’

(ইসলামে নতুন চাঁদের বিধান ও এ সম্পর্কিত বিতর্ক নিরসন।) অনুবাদ: কামাল আহমদ, যশোর, পৃ. ১৩৬

অথচ হেদায়ায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত শিরোনামে তো দূরের কথা, এই মাসআলারই কোনো উলেস্নখ সেখানে নেই। যাই হোক, আতাউল্লাহ  ডায়রভীর মূল উর্দূ রিসালা এবং পাকিস্তানে তার জবাবে যেসব রিসালা লেখা হয়েছে সেগুলো যেহেতু সরাসরি আমাদের হাতে নেই তাই কেবল তরজমার ভিত্তিতে তার উপর পর্যালোচনা পেশ করা সঙ্গত মনে হয় না। এমনিতেও এত বিশদ আলোচনার পর আলহামদুলিল্লাহ, পৃথক কোন পর্যালোচনার প্রয়োজনও নেই। তবে যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হকের বইয়ে আশ্চর্য রকমের সব নিত্য-নতুন বিকৃতি ও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অবাস্তব কথাবার্তা রয়েছে, যা কারো কারো জন্য বিভ্রান্তি কিংবা ভোগান্তির কারণ হতে পারে; তাই এর উপর আমিও পর্যালোচনার প্রয়োজন অনুভব করছি।

আরো একটি বইয়ের উপর পর্যালোচনা প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আমি সেটিও ছাপতে চাচ্ছি না। কেননা নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি জানতে পেরেছি যে, এ বইয়ের লেখক বেচারা মসজিদে নামাযের জামাতে, এমনকি জুমাতেও উপস্থিত হন না। কারণ ইমামতির উপযুক্ত ইমাম তিনি কোনো মসজিদেই খুঁজে পান না!!

আর প্রকাশ্য যে, এমন খারেজী মনমানসিকতার কোনো লোকের বই নিয়ে আলোচনার কোনো মানে নেই। কেননা যিনি জুমা ও জামাতে হাজির হওয়া থেকে বিরত থাকেন তিনি কোন্ ঈদগাহে নামাজ পড়বেন? নামাজের বিষয়ে যার এই মতি সে লোক একই দিনে রোযা ও ঈদ পালনের দাওয়াতে কি ন্যায়নিষ্ঠ হবে? এমনিতে তার পুস্তকটি তো ধোকা ও জালিয়াতি এবং মূর্খতা ও জাহেলিয়াতে ভরপুর। তবু আমি সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা লিখেছিলাম। কিন্তু তার সম্পর্কে ঐ তথ্য পাওয়ার পর আমি পর্যালোচনাটি আর ছাপা সমীচীন মনে করিনি।

মোটকথা, এখন শুধু ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হকের বই চান্দ্রমাস নিয়ে আলোচনা হবে, ইনশাআল্লাহ। এবং এর মধ্য দিয়ে প্রবন্ধের এই পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটবে। l

وما توفيقي الا بالله عليه توكلت واليه أنيب

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement