রবিউল আউয়াল ১৪৩৬   ||   জানুয়ারি ২০১৫

সীরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

যে কোনও নির্মাণকার্যের জন্য নির্মাতাকে কোন মডেল বা আদলের অনুসরণ করতে হয়। অন্যথায় সে নির্মাণকার্য সুচারু হয় না। মডেল যত নিখুঁত ও পরিণত হয়, নির্মাণও সেই অনুপাতে পরিপূর্ণতা পায়। এটা যেমন স্থূল নির্মাণের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সূক্ষ্ম নির্মাণও  এর ব্যতিক্রম নয়, বরং সেক্ষেত্রে নকশা-নমুনার অনুসরণ আরও বেশি জরুরি। বস্তুত বর্তমানে মডেলের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার কিছু প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কেননা এখন এটা একটা বাস্তব বিষয়। সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রতিটি বিভাগ মডেলের উপর ভিত্তি করেই চলছে।

মডেলের যে এত সমাদর ও এত গুরুত্ব সে তো মানুষের বস্তুগত উন্নতিরই স্বার্থে। বস্তুগত উন্নতিও উন্নতি বটে এবং সে উন্নতির প্রয়োজনও নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য, কিন্তু সেই উন্নতি যার স্বার্থে, সেই মানুষের নিজের উৎকর্ষ তো আরও বেশি প্রয়োজনীয়। কেননা মানুষ যদি সুশীল ও সুকুমারমতি না হয়, সে যদি উৎকর্ষমন্ডিত ও সর্বাঙ্গসুন্দর না হয়, তবে বস্তুগত উন্নতি তার সমূহ দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। অধুনা বিশ্বকে কি আমরা সেই রকমের দুর্ভোগে জেরবার হতে দেখছি না?

বস্তুগত উন্নতির জন্য যদি মডেলের অনুসরণ প্রয়োজনীয় হয়, তবে মানুষের মানবিক উৎকর্ষের জন্য কেন মডেলের দরকার হবে না? নিঃসন্দেহে দরকার। যুগ-যুগান্তরের আলোকিত মানুষেরা কোন না কোন মডেল তথা আদর্শস্থানীয় ব্যক্তির অনুসরণ করেই নিজেদের জীবনে বিপ্লব এনেছেন। এটাই জীবন গড়ার আসল পন্থা। অনুকরণীয় ব্যক্তির অনুসরণ ছাড়া কারও পক্ষেই নিজেকে আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেননা যতক্ষণ না সামনে সে রকম কোন ব্যক্তি থাকে ততক্ষণ নিজ ত্রুটি ও কমতি দৃষ্টিগোচর হয় না। অনুকরণীয় ও পরিণত মানুষ অপরের পক্ষে দর্পণস্বরূপ। সে দর্পণের সামনে যারা নিজেদের তুলে ধরে, তারা তাদের অভাব নিরূপণে সক্ষম হয়। এরপর সে অভাব মোচন করতে জীবনকে ঋদ্ধ করে তোলার দিশা পায়।

আম্বিয়ায়ে কেরাম স্ব-স্ব যুগে মানুষের জীবন গড়ার মডেল হিসেবে দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন। এ ধারার সর্বশেষ আদর্শ হচ্ছেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি মানুষের জীবন রচনার জন্য নিজেকে এক নিখুঁত ও পরিপূর্ণ নকশা হিসেবে জগদ্বাসীর সামনে পেশ করেছিলেন। সে নকশা দেখে যারা নিজেদের গড়ার চেষ্টা করেছেন, তারা সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। তার শরীরী সত্তা ইহলোক থেকে বিদায় নিয়ে গেছে বটে, কিন্তু তাঁর আদর্শিক সত্তার কোন মৃত্যু নেই। কিয়ামতকাল পর্যন্ত তার অনির্বাণ জীবনাদর্শ মানুষকে তাদের চলার পথের দিশা দিয়ে যাবে। মানুষের কর্তব্য তাঁকে পাঠ করা।

হ্যাঁ প্রিয় পাঠক! আপনি জীবনে অনেক কিছুই পড়ে থাকবেন। আরও অনেক পড়বেন এবং পড়তেই হবে। কেননা জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য পাঠের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সেই পাঠের ভেতর আপনার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং সেটা আপনার জীবন নির্মাণের স্বার্থে। আমরা জীবনের মাত্র কয়েকটা ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা তুলে ধরছি।

বহিরঙ্গের পরিপাট্যের জন্য

একজন সভ্য-ভব্য ও সুন্দর মানুষ হতে হলে বাহ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রসাধন অপরিহার্য। অপরাপর গুণাবলি যতই উচ্চমানের হোক, যদি বহিরঙ্গ পরিপাটি না হয়, তবে সে মানুষ কখনই সভ্যজনদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বহিরঙ্গের সৌন্দর্য আনয়নের জন্য চাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচর্যা তথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, চুল-দাড়ির কাট ও বিন্যাস, নখ ও বাড়তি পশমের সাফাই, আতর ও সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি। সেই সঙ্গে মার্জিত পোশাক-আশাকও এর এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু রুচিবোধের পার্থক্য, স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতির তারতম্য, আত্মমর্যাদাবোধের অভাব, হীনম্মন্যতা ও অনুকরণ-প্রবণতা ইত্যাদি কারণে এক্ষেত্রে নানা রকমের ঢং-ঢাং পরিলক্ষিত হয়, যার অধিকাংশই ভদ্রজনোচিত নয়। আপনি যদি এক্ষেত্রে একজন সুন্দরতম মানুষ হিসেবে নিজেকে অলঙ্কৃত করতে চান, তবে সকল ভদ্রের সেরা ভদ্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীগ্রন্থ পাঠ করুন। সেখানেই আপনি পাবেন সুন্দরতম অঙ্গসজ্জা ও শ্রেষ্ঠতম বেশবিন্যাস, যার অনুসরণ আপনাকে করে তুলবে সুদর্শন ও মার্জিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ও রাশভারী।

অন্তর্জগত আলোকিত করার জন্য

বহিরঙ্গের চেয়ে মনোজগতই মানুষের বেশি দামি, বরং এটাই তার প্রকৃত সারবত্তা। এটা বহু গুণের লালন ক্ষেত্র, বিপুল সম্ভাবনার বিচিত্র ভুবন। এ ভুবনের চাষাবাদ, প্রাত্ন-পরিচর্যা দ্বারা একজন  মানুষ লোক থেকে লোকোত্তর পুরুষে পরিণত হতে পারে। আবার অবহেলা অনাদরের ফলে এখানে এতটা আগাছা ও পাশববৃত্তির জন্ম নেয়, যা মানুষকে পরিণত করতে পারে হিংস্রতম হায়েনায়। কিন্তু আফসোস! আজকে এদিকটা নিদারুণভাবে উপেক্ষিত। মানুষের সর্বাত্মক চেষ্টা ব্যয় হচ্ছে বস্তুগত উন্নতির পেছনে। সে আজ তার শারীরিক চাহিদা ও পাশববৃত্তি  চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় উন্মাতাল আর যে প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে তার সুকুমারবৃত্তিসমূহ। এভাবে ঘটছে মানুষের মানবিক আত্মহনন।

প্রিয় পাঠক! আমাদেরকে এই সর্বনাশা প্রবণতা পরিহার করে মানবিকতার চর্চায় মন দিতে হবে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে অন্তর্লোকে নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। তা কোথায় পাব সে পথের দিশা? হ্যাঁ, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত। সেখানে পাওয়া যাবে উত্তম চরিত্রের বিকশিত রূপ পরিপূর্ণ মাত্রায়।

আপনি আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠ করুন। যেখানে পাবেন সত্যবাদিতা, সাহসিকতা, কোমলতা, দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহানুভূতি-সহমর্মিতা, কল্যাণকামিতা, বদান্যতা, ধৈর্য- সহিষ্ণুতা, স্নেহ-মমতা, পরমত সহিষ্ণুতা, আত্মসচেতনতা, আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা, আপন কাজে নিষ্ঠা ও অবিচলতা, ন্যায়ের প্রতি আনুকূল্য, অন্যায়ের প্রতি বজ্র-কাঠিন্য, অটুট মনোবল, নিঃস্বার্থ ত্যাগ-তিতিক্ষা। মোদ্দাকথা উন্নত চরিত্রের সকল উপাদান।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিতের এ অধ্যায় নিঃসন্দেহে তার আগ্রহী পাঠককে উন্নত ও মহৎ চরিত্রের পথনির্দেশ করে এবং কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে তার অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং নিজের ভেতর উন্নত চরিত্রের বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে প্রতিটি মানুষের উচিত সীরাত পাঠকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গুরুত্ব দেওয়া।

আচার-আচরণকে শিষ্টতাপূর্ণ করার জন্য

সমাজবদ্ধ প্রাণী হওয়ার কারণে মানুষের পক্ষে আচার-আচরণের শিষ্টতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্জিত আচরণ শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করে, পরকে আপনার করে তোলে এবং সমাজে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে। পক্ষান্তরে অশিষ্ট আচরণ এর বিপরীত ফল আনয়ন করে, যা মানবসমাজের পক্ষে কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু সমাজে কি সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিই বিরাজ করছে না? এবং আমাদের শিষ্টতা-বর্জিত আচরণ কি সে পরিস্থিতির জন্য বহুলাংশে দায়ী নয়? সুতরাং আমাদের সংশোধন দরকার। সর্বস্তরের মানুষের উচিত নিজের আচার-আচরণকে মার্জিত ও পরিশীলিত করে তোলা। আর নিঃসন্দেহে সে মার্জিত ব্যবহারের সবক পাওয়া যাবে সীরাত গ্রন্থে। মজলিসে কীভাবে বসতে হবে, আগন্তুককে কীভাবে বিদায় জানাতে হয়, আগন্তুককে কীভাবে সম্বোধন করতে হবে, অতিথিকে কীভাবে বিদায় জানাতে হয়, পথচারী আপনার কাছে কী ব্যবহার চায়, সাথী-সঙ্গী ও ছোট-বড় ভেদে আচরণের কী তারতম্য হওয়া দরকার, ইশারা-ইংগিতের প্রয়োগ কী রকম হওয়া চাই, প্রশ্ন ও উত্তরের ধরণ-ধারণ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীগ্রন্থ পাঠ করতে হবে।

বিশুদ্ধভাষী ও সদালাপী হওয়ার জন্য

সীরাত পাঠ মানুষকে শুদ্ধ ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সদালাপী হতে উৎসাহ যোগায়। সীরাতের একজন আগ্রহী পাঠক দেখতে পায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাতে বিশুদ্ধ ভাষা শিখতে পারেন, তাঁর শৈশবে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। জীবনভর তিনি বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছেন। তাঁর মুখের ভাষা আরবী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, তাদেরকেও সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর ভাষা হত সুস্পষ্ট, বাহুল্যবর্জিত ও সহজবোধ্য। তাঁর মধুর ভাষণ শ্রোতাকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করত। চরম বিদ্বিষ্ট ব্যক্তি পর্যন্ত তার বচন শুনে চমৎকৃত হত। ভাষার রুঢ়তা তিনি পছন্দ করতেন না। গালমন্দ ও অশ্লীলতা তার ভাষায় ঠাঁই পেত না। একদিকে তাঁর স্নিগ্ধ ভাষা হতদরিদ্র বেদুঈন বৃদ্ধার হৃদয় সঞ্জীবিত করত, অন্যদিকে তার শাণিত তেজস্বী বাক্যে দুর্দান্ত আরব্য সর্দারের অন্তরাত্মা প্রকম্পিত হত।

বস্তুত ভাষা আল্লাহ তাআলার কুদরতের এক অনন্য নিদর্শন। এর দ্বারা কেবল মনের ভাবই ব্যক্ত হয় না, এর কার্যকরিতা বহুবিধ। এর কাছে তরবারি হার মানে, যাদু মানে বশ। প্রয়োজন শুধু মোক্ষম ব্যবহারের। অন্তরে সেই তাগিদ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিত সীরাত গ্রন্থসমূহকে নিজের জন্য অবশ্যপাঠ্য করে নেওয়া।

চরিত্রের ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য

বলা হয়ে থাকে সবকিছুতে মধ্যম পন্থাই শ্রেষ্ঠ, প্রান্তিক কর্মপন্থা ও একদেশদর্শী মানসিকতা সকলের কাছেই নিন্দনীয়। কাউকে ভালবাসবেন, তো সে ভালবাসার একটা মাত্রা থাকা চাই। আবার সংগত কোন কারণে কারও সাথে শত্রুতা সৃষ্টি হলে, সে শত্রুতাও যেন সীমা না হারায়। অর্থোপার্জন করুন, কিন্তু  উন্মত্ত হয়ে নয়, আবার বিত্তে নিরাসক্তিও যেন বৈরাগ্যে পর্যবসিত না হয়। এমনিভাবে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও পরিমিতি রক্ষা করা চাই। ব্যয়কুণ্ঠা যেমন দোষ, তেমনি অমিতব্যয়ও প্রশংসনীয় কিছু নয়।

মোটকথা আহার-বিহার, আনন্দ-বিপদ, পরিশ্রম ও বিশ্রাম সবকিছুতেই মধ্যমপন্থা অবলম্বন জীবনের পক্ষে সুখকর। কিন্তু আমরা কি করছি? সকল ক্ষেত্রেই আমরা কি প্রান্তিক আচারে অভ্যস্ত নই? আমরা যখন আনন্দ করি তখন সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে যাই, আবার যখন অবসাদে পায়, তখন সম্পূর্ণ অকর্মণ্য হয়ে পড়ি। জীবনের সকল ভুবনেই আমরা প্রচন্ড অমিতাচারী। তাই যে সুখের সন্ধানে আমরা ভবঘুরে, কিছুতেই তার নাগাল পাই না। ব্যর্থ ও পরাস্ত জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াই আমৃত্যু। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে জীবনের সমস্ত আচার-আচরণে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। অভ্যস্ত হতে হবে মধ্যমপন্থায় চলতে। আর সে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে। তাই সফল জীবনের প্রত্যাশীকে সীরাত পাঠে মনোযোগী হতে হবে।

আদর্শ পেশাজীবী হওয়ার জন্য

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা অর্থনৈতিক জীবন ছিল, যেমন আমাদেরও আছে। আমরা জীবন নির্বাহের জন্য বিভিন্ন রকমের পেশা অবলম্বন করে থাকি। চাকরি-বাকরি, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি পন্থায় আমরা অর্থোপার্জন করি। এসকল ক্ষেত্রে আমরা সৎ ও আদর্শ জীবনের প্রতিভূ কি না, তা যাচাই করতে হলে আমাদেরকে সীরাত পাঠ করতে হবে এবং সেই মুকুরে নিজেদের চেহারা দেখতে হবে।

দায়িত্বসচেতন হওয়ার জন্য

মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উপর নানাবিধ দায়-দায়িত্ব অর্পিত আছে। পারিবারিক, নৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি। এসব দায়-দায়িত্বের প্রতি আমরা খুব কমই সচেতন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা নিজ দায়িত্ব পালনে উদাসীন থেকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মেতে উঠি। বরং সাম্প্রতিক বিশ্বের সর্বাঙ্গন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মুখরিত। অথচ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ আপন আপন দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকলে এসব হিংসাত্মক তৎপরতার কোন প্রয়োজন থাকত না। যে ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-চরিত পাঠ করবে, সে নিঃসন্দেহে এই সত্য মরমে মরমে উপলব্ধি করবে। তাঁর গোটা জীবনই ছিল দায়িত্ব সচেতনতার মূর্ত-প্রতীক।

     দেখুন, আর সকলের মত তাঁরও ছিল পরিবার-পরিজন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবৃত একটি পারিবারিক জীবন তিনি যাপন করতেন। এমনিভাবে তাঁর ছিল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী; ছিল একটি বৃহত্তর সমাজ এবং একটি রাষ্ট্র। যেমন আমাদেরও আছে। তা তিনি কেমন স্বামী ও পিতা ছিলেন? আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে তাঁর আচরণ কেমন ছিল? এ সকল ক্ষেত্রে একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে তাঁর জীবনের এ সকল অধ্যায় আপনাকে পড়তে হবে। এমনিভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ, এমনকি জীব-জন্তু ও পরিবেশ বৈচিত্রের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, সে ব্যাপারে জাগ্রত-চিত্ত হওয়ার জন্য সীরাতগ্রন্থের পাতা উল্টানো অপরিহার্য। এসকল ক্ষেত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরিত জীবন নিঃসন্দেহে আপনার আমার দায়িত্ববোধকে আন্দোলিত করবে।

সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি আস্থা ও মনোবল সৃষ্টির জন্য

মানবজীবন আগাগোড়াই সংগ্রাম। সর্বাবস্থায় তাকে প্রতিকূল হাওয়ার মধ্যে চলতে হয়। কোন ক্ষেত্রেই তার যাত্রা পথ অবাধ নয়। দেহ-মনের প্রতিপালন, চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের লালন, অর্থোপার্জন, সহায়-সম্পত্তির সংরক্ষণ, সভ্যতা-সংস্কৃতির নির্মাণ তথা জীবন-ভুবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে একের পর এক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। নিরন্তর লড়াই নিঃসন্দেহে ক্লান্তিকর। তদুপরি এ লড়াই কখনও এমন ঘোরতর হয়ে ওঠে এবং প্রতিপক্ষ এতটাই শক্তিশালী হয়ে আসে, যার সামনে তিষ্ঠানোই দায় হয়ে পড়ে। এরকম পরিস্থিতিতে নিজ অবস্থান ধরে রাখার জন্য দরকার আল্লাহর প্রতি চরম আস্থা ও দুর্দমনীয় মনোবলের। এরকম আস্থা ও মনোবলের পরাকাষ্ঠা দেখা যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শে। আবূ তালিব উপত্যকার অবরুদ্ধ জীবন, তায়েফ সফর, হিজরত, হামরাউল-আসাদ ও হুনায়নের যুদ্ধ প্রভৃতি ঘটনা পাঠ করে দেখুন আল্লাহ তাআলার প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের এমন নযীর আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না। এসব ঘটনার ভেতর আপনার জীবন-যুদ্ধের রসদ পেয়ে যাবেন। সুতরাং সীরাত পাঠ করুন। আল্লাহ তাআলার প্রতি অবিচল আস্থাশীল হয়ে উঠুন। হৃদয়ে অটুট মনোবল সঞ্চার করুন।

শোকে-দুঃখে সান্ত্বনা লাভের জন্য

জীবনে যেমন প্রাপ্তি-সুখ আছে, তেমনি আছে বিয়োগবেদনাও। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ একদিকে সুখের অগণ্য উপকরণ লাভ করে, অন্যদিকে সেইগুলোই সে একটি একটি করে হারাতে থাকে। এটা প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। কিন্তু যতই সাধারণ নিয়ম হোক, লব্ধ জিনিস কেউ হারাতে চায় না। তার সাথে একটা প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে। সে বন্ধনের বিচ্ছেদ কারও কাছেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই প্রকৃতির সাধারণ ধারায় যখন তা হারিয়ে যায়, তখন হৃদয়ে দুঃখ জাগে, মানুষ শোকাহত হয়।

জন্মাবধি মানুষ কত কি যে হারায় তার কোন ইয়ত্তা আছে? অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শক্তি-সামর্থ্য, ধন-মান, পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কত কি! এর কোনোটাই কম দামি নয়। কোনটা অমূল্য। একের পর এক এ সবের বিয়োগ-ব্যথা মানুষকে জর্জরিত করে। কখনও প্রচন্ড শোকে হৃদয় মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সেই কাতর অবস্থায় আত্ম-সংবরণের জন্য দরকার আশ্বাস বাক্যের, চাই সান্ত্বনা; অন্যথায় মানব জীবন বিকল ও স্থবির হয়ে পড়ে। অনেক সময় সাংঘাতিক রকমের দুর্ঘটনাও ঘটে যায়, যার প্রতিকারের কোন উপায় থাকে না। তা কোথায় পাওয়া যাবে সেই সর্ব-শোক-হারক সান্তবনা? নিঃসন্দেহে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-চরিতে। তাঁর জীবনেও বহু দুঃখ-বেদনা এসেছে। অনেক বড় আকারে এসেছে। কত রকমে যে তাকে দুঃখ-জর্জরিত হতে হয়েছে সীরাত-পাঠকের তা অজানা নয়।

আল্লাহ তাআলার এই সর্বপ্রিয় হাবীবকে যখন দুঃখ পোহাতে হয়েছে, তখন আপনাকে আমাকেও পোহাতে হবে বৈকি। এটা আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।

প্রিয় পাঠক! মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতগ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এটা একটা সংক্ষিপ্ত সারণী মাত্র। তাঁর গোটা জীবনই আপনার-আমার জীবন রচনার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। কুরআন মাজীদের ভাষায়-

 لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তার জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’-সূরা আহযাব : ২১

আসুন, তাঁর সে আদর্শ জানার লক্ষ্যে আমরা সীরাতবিষয়ক গ্রন্থসমূহ পাঠ করি এবং তার আলোকে নিজেদেরকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। l

(আলকাউসার রবিউল আউয়াল ১৪২৬; এপ্রিল ২০০৫ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত)

 

 

 

advertisement