সফর ১৪৩৬   ||   ডিসেম্বর ২০১৪

দ্বীনের সমঝ কাকে বলে?

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[জুমার বয়ান]

وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا

কুরআন মাজীদের একটি আয়াতের অংশবিশেষ তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যাকে হিকমাহ দান করা হয়েছে তাকে অনেক কল্যাণ দেয়া হয়েছে।’ হিকমাহ যে পেয়েছে সে অনেক কল্যাণ পেয়েছে।

            হিকমাহ শব্দের অনেক অর্থ আছে। কুরআন মাজীদেও বিভিন্ন অর্থে এই শব্দটি এসেছে। এই আয়াতে হিকমাহ এর যে অর্থ তা হল দ্বীনের সমঝ। যে দ্বীন ইসলাম আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দিয়েছেন সেই ইসলামের সমঝ হল হিকমাহ বা হিকমত। মূল শব্দ হলো الِحكْمة। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিতেন উম্মতকে, সাহাবায়ে কেরামকে। কোনো সময় আয়াত তিলাওয়াত করে তিলাওয়াত শিখাতেন। সাথে সাথে আয়াতের বিধানের উপর আমল করে দেখাতেন। অর্থ বুঝিয়ে দিতেন। আর অনেক সময় আয়াতের মর্মকে বিভিন্ন ভাষায় বলতে থাকতেন। যাতে এই বিষয়টি তাঁদের হৃদয়ঙ্গম হয়ে যায়। আত্মস্থ হয়ে যায়। এই আয়াতটিকেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসরূপে বারবার বলেছেন সাহাবায়ে কেরামকে।

 من يرد الله به خيرا يفقهه في الدينÕ

‘যার ব্যাপারে আল্লাহ কল্যাণের ইচ্ছা করেন তাকে দ্বীনের সমঝ দান করেন’। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১

সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের অনেক কিতাবে এই হাদীস আছে। হাদীসের সামনের অংশে আছে-  إنما أنا قاسم والله يعطي ‘আমি তো বণ্টনকারী, প্রকৃত দাতা আল্লাহ’। অর্থাৎ ওহীর জ্ঞান আমার কাছে আসে। সেই ইলম আমি (রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বণ্টন করে দেই। অক্ষরে অক্ষরে উম্মতের কাছে পৌঁছে দেই। কিন্তু সমঝ দান করার মালিক আল্লাহ।

            আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে প্রাপ্ত সব কিছু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। একটি অক্ষরও এমন নেই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছাননি। এমনটি হতে পারে না।   তো সবাই হাদীস শুনল, আয়াত শুনল, পড়ল, ইয়াদ করল। কিন্তু সমঝ? সেটা আল্লাহর দান। এর ব্যাপারে বলা হচ্ছে, والله يعطي  প্রকৃত সমঝ আল্লাহ তাআলা দান করেন। বসে বসে আমি খুব পড়ছি, পাঠ গ্রহণ করছি, কিন্তু সহীহ সমঝ আসতে হলে আল্লাহর দান লাগবে। এজন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। ইসলামের সঠিক সমঝ পেতে হলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত হতে হবে।

            আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত হওয়ার তরীকা কী? আল্লাহর বিধি-বিধানগুলো মেনে চলা। তাকওয়ার রাস্তা অবলম্বন করা। সুন্নাতের রাস্তা অবলম্বন করা, কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা। ফিকির এবং দুআ করা। আর যেসব কাজে আল্লাহ নারায হন সেসব কাজ থেকে বেঁচে থাকা। যেসব কাজে আল্লাহর রহমত নাযিল হয় সেসব কাজ বেশি বেশি করা। এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত হবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক যত মজবুত হবে আল্লাহ তত বেশি দ্বীনের সমঝ দান করবেন।

            মাসআলা-মাসায়েল জানলাম, লিখলাম, মুখস্থ করলাম তাহলে কিছু তথ্য আমার কাছে আসল। খুব ভাল, অগ্রসর হলাম। শুধু কিছু তথ্য সংগ্রহ করার নাম সমঝ নয়। সমঝ আরো সূক্ষ্ম, আরো গভীর একটি ধাপের নাম। অনেক কিছু জানা আছে, কিন্তু সমঝের অভাবে মানুষ সেটার সঠিক প্রয়োগ করতে পারে না। জানা জিনিসের সঠিক ব্যবহার, সঠিক প্রয়োগ তখনই হয় যখন সমঝ থাকে। এজন্য একটা শব্দ হল ইলম, আরেকটা শব্দ হল ফিকহ। ইলম লাগবে এবং ফিকহও লাগবে। আপনারা শুনেছেন علم الفقه -এর কথা। বাংলায় বলে ফেকাহশাস্ত্র। এই ফেকাহশাস্ত্রের মধ্যে কী পেশ করা হয়েছে? কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কেরাম বুঝেছেন, তাদের থেকে তাবেয়ীরা, তাদের থেকে তাবে-তাবেয়ীরা এভাবে মুজতাহিদ ইমামগণ, ফকীহগণ বুঝেছেন। আর যার কাছে কিতাব-সুন্নাহর সঠিক সমঝ আছে তিনি হলেন ফকীহ। যত মুজতাহিদ ইমাম ছিলেন তারা হলেন ফুকাহা শ্রেণীর আলেমদের শীর্ষে। ইমাম আবু হানিফা রাহ., ইমাম মালিক ইবনে আনাস, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এঁরা সবাই এই সত্মরের। আলেম থেকে উপরের স্তর হল ফকীহ।

            রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রহমতে সাহাবাদের কুরআন-সুন্নাহ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সমঝটা ধারাবাহিকভাবে ফকীহ ও মুজতাহিদ ইমামদের কাছে পৌঁছেছে। তাঁরা এই সমঝকে ধারণ করেছিলেন। এর বদৌলতেই তারা সংকলন করতে পেরেছিলেন ইলমুল ফিকহ ওয়াল ফতওয়া।

            এই ফিকহ যেহেতেু কুরআন-সুন্নাহর বিধানাবলির সুবিন্যস্ত ও সংকলিত রূপ এজন্য এটা হলো ইলমুল ফিকহ। অর্থাৎ ফিকহুল কুরআন এবং ফিকহুস সুন্নাহ। এখানে যাদের সমঝ পেশ করা হয়েছে তারা হলেন ফকীহ। যে সমঝটা ফিকহ শাস্ত্রে পেশ করা হয়েছে ওটার মাধ্যমে, ওটার সহযোগিতা নিয়ে আমল করতে হবে কুরআন-সুন্নাহর উপর। তাহলে আমলটা সঠিক হবে। কুরআন-সুন্নাহ বুঝার জন্য, শরীয়তের বিধান বুঝার জন্য ফকীহদের শরণাপন্ন হওয়ার কথা আল্লাহর রাসূলও বলেছেন, আল্লাহ তাআলাও বলেছেন-

 فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ     

            সূরা তাওবার শেষের দিকে উপরোক্ত আয়াত রয়েছে। আর হাদীস তো অনেক আছে।

            আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ইলম এবং ফিকহ-এর পার্থক্যের বিষয়টি। হাদীসের কিছু কিতাবের অনুবাদ হয়েছে, সেগুলো পড়ে কেউ হয়ত কিছু তথ্য জানতে পারে, কিন্তু সমঝ? অনুবাদের ব্যাপারে একটি কথা বলা দরকার। যে কোনো অনুবাদই-কি পড়া যায়? কাদিয়ানিরাও তো কুরআনের অনুবাদ করেছে। খ্রিস্টানরাও অনুবাদ করেছে। হিন্দু কুরআনের অনুবাদ করেছে। এমন মুসলমানও কুরআনের অনুবাদ করছে,  যে নিয়মতান্ত্রিক ইলমে দ্বীন শেখেনি।

হয়ত ইংরেজি কোনো অনুবাদকে ভায়া করে কু্রআন পড়েছে, তারপর বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছে। অনুবাদকের নাম দেখা যায় ‘বিচারপতি’, আলেম নন। ফকীহ তো অনেক দূরের কথা। ডাক্তার কুরআনের অনুবাদ করছে, কুরআনের মজলিশ করছে। প্রতি মাসে কুরআনের মজলিশ করছে ‘কোরআনিয়া’ নামে। তিনি ওই মজলিশের সভাপতি। কোনো ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। আপনি কিছু বলবেন তাহলে উত্তর দিবে ‘আল্লাহ সবার জন্য কুরআন নাযিল করেছেন’। কুরআন সবার জন্য নাযিল হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু এর মানে কী? এর অর্থ হল, সবার কুরআনের উপর ঈমান আনতে হবে। সবাইকে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। সবাইকে কুরআন বুঝতে হবে। কুরআনের বিধানের উপর আমল করতে হবে। কিন্তু সবাই কুরআনের তাফসীর করবে-এজন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন অবতীর্ণ করেছেন?

            দেশের আইনের বইতে আইন লেখা আছে। আইনগুলো তো সবার জন্য। সবাইকে দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের আইন মেনে চলতে হবে। কিন্তু সবাই কি আইনজ্ঞ হবে? সংসদে আইন করা হল। ওটা বাংলা ভাষায়, আমার মাতৃভাষায় লেখা হয়েছে। আমি ভার্সিটির বাংলা ভাষার প্রফেসর। আমার অধিকার নেই ওটার ব্যাখ্যা করার। আমি ব্যাখ্যা করলে সেই ব্যাখ্যার কোনো মূল্য নেই। ওটা ধর্তব্য হবে না। একজন আইনজ্ঞ যে ব্যাখ্যা দিবেন সেই ব্যাখ্যাই ধর্তব্য হবে। এখানে তো এই স্বীকৃত নীতি সবাই বুঝে, কিন্তু কুরআনের ক্ষেত্রে? সেখানে কোনো নিয়ম-নীতি নেই? যার মন চায় সে-ই তাফসীর করা শুরু করবে? ‘কুরআন সবার জন্য’ অর্থ হল,  ঈমান আনার জন্য, কুরআনের হেদায়েত গ্রহণ করার জন্য, আমল করার জন্য, বুঝার জন্য কুরআন সবার। ‘সবার জন্য’ বলে আপনি তাফসীর করা শুরু করে দিবেন? ইংরেজি একটা অনুবাদ পড়ে আপনি মুফাসসিরে কুরআন হয়ে যাবেন? কুরআনের দরস দেয়া শুরু করবেন আপনি?

            আমি বলতে চাচ্ছিলাম সমঝ দরকার। এখন তো অবস্থা এই যে, এক দু’টি কিতাবের অনুবাদ পড়ে, আর মনে করতে থাকে এখন যেহেতু আমি হাদীসের অনুবাদ পেয়ে গেছি, এখন আর কোনো আলেমের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমল নিজেই শুরু করে দেয়।  সে তথ্য পেয়েছে, কিন্তু প্রয়োগের পদ্ধতি  শেখেনি। যেমন একজন বুখারী শরীফের একটি অনুবাদ সংগ্রহ করল। যখন সে বুখারী শরীফের সালাত অধ্যায় পড়ল, সে দেখল সেখানে একটি অধ্যায় আছে , ‘সশব্দে আমীন বলা প্রসঙ্গ’। এই শিরোনামের অধীনে একটি হাদীস এলো-

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا قال الامام غير المغضوب عليهم ولا الضالين فقولوا آمين

অর্থ: ‘যখন ইমাম غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলেন তখন তোমরা আমীন বল’।

            অধ্যায় তো হল, ‘সশব্দে আমীন বলা প্রসঙ্গ’, কিন্তু এর অধীনে হাদীস এসেছে এটা। এই হাদীসে কি জোরে কিংবা আস্তে আমীনের কথা এসেছে? শুধু আছে ‘তোমরা আমীন বল’। ‘তোমরা সশব্দে আমীন বল’-এই কথা তো হাদীসে নেই। জোরে কিংবা আস্তে আমীনের বিষয়টা অন্য হাদীস থেকে নিতে হবে। কিন্তু যেহেতু শিরোনামে বলা হয়েছে ‘সশব্দে আমীন বলা প্রসঙ্গ’ ব্যস! এখান থেকে পড়ে তিনি মসজিদে এলেন, এখন দেখেন যে মসজিদে সবাই আস্তে আমীন বলে। কিন্তু তিনি যেহেতু বুখারীতে পড়ে এসেছেন, তাই মসজিদে এসে জোরে আমীন বলতে শুরু করেন। তিনি জোরে আমীন বলেন আর মনে মনে ভাবতে থাকেন, হায়রে! এতবছর শান্তিনগরে জুমার বয়ান শুনলাম কোনোদিন তো খতীব সাহেব আমাদেরকে এই হাদীস শোনালেন না যে, আমীন জোরে বলতে হয়। আজকে তো আমি নিজেই বুখারী শরীফে পড়লাম। কাজেই কোনো অপেক্ষার দরকার নেই। আজকে মসজিদে গিয়েই জোরে আমীন বলব। কারণ, এই সুন্নাত তো এখানে নেই। মুর্দা সুন্নাত যদি যিন্দা করা যায় তাহলে শহীদের সওয়াব, তো এখন মসজিদে এসে জোরে আমীন বলতে শুরু করল।

            চিন্তা করা দরকার ছিল, এই দেশে বুখারী শরীফ কি কেবল আমি পড়ি, নাকি আরো কেউ পড়ে? যে হুযুরের পিছনে এতদিন নামায পড়লাম, যে হুযুরদের কাছ থেকে আমি নামায শিখলাম, তাদের মাদরাসায়ও তো বুখারী শরীফ সারা বছর পড়ানো হয়? প্রতি বছর বুখারী শরীফ পড়ছেন, পড়াচ্ছেন। এই বেচারাদের কি এতই দুর্বল ঈমান যে পড়বে একটা আর আমল করবে আরেকটা, জনগণকে এটা জানাবেই না? আপনার মধ্যে বুখারী শরীফ পড়ে এটার উপর আমল করার জযবা এল। নিজের ব্যাপারে এত সুধারণা যে, এখনই আমল করতে হবে। কিন্তু দেশের এত আলেমদের ব্যাপারে এই মন্দ ধারণা কেন যে, তারা হাদীসের উপর আমল করে না? আপনার এই প্রশ্ন কেন আসে না যে তাঁরাও তো এই হাদীস পড়েন, পড়ান। কথার কথা, শাইখুল হাদীস আজীজুল হক ছাহেব তো বুখারীর অনুবাদ করেছেন, তিনি কেন এই হাদীসের উপর আমল করেন না, একটু গিয়ে জিজ্ঞেস করি। এই প্রশ্নটা আসে না। নিজে নিজে আমল করতে শুরু করে দেয়।

            এটা হল দ্বীনের সমঝের অভাব। হাদীস জেনেছি, আমার হাদীসের ইলম হয়েছে, কিন্তু দ্বীনের সমঝের অভাব আছে বিধায় আমি প্রয়োগ করতে পারিনি। প্রয়োগ করলাম কী? এক মসজিদে প্রবেশ করলাম, জোরেশোরে আমীন বললাম। নামাযের পরে কেউ বলল, ভাই ব্যাপার কী? তখন বলে, এই মিয়া! তোমরা তো হাদীসের উপর আমল কর না, সুন্নত মোতাবেক নামায পড় না (?) এই যে হাদীসে জোরে আমীনের কথা আছে। যদি তার দ্বীনের সমঝ থাকতো তাহলে সে বুঝতো যে, একটা তথ্য আমি পেয়েছি। কিন্তু এটার উপর আমল করার পদ্ধতি কী হবে? আমি যাই, জিজ্ঞেস করি একজন আলেমকে। যদি সে একজন আলেমের কাছে আসত তাহলে বুঝত যে, হাদীসের মধ্যে দু’ধরনের হাদীস আছে।

লক্ষ্য করুন, দুই রাকাত নামায আমি পড়ব। প্রতি রাকাতে দুইটা রুকু নাকি একটা রুকু?  -একটা রুকু। সেজদা দুইটা নাকি একটা? -দুইটা সেজদা। দুই রাকাতে বসা একবার না দুইবার? -একবার। কিয়ামের মধ্যে আপনি ফাতিহা পড়বেন তারপর সূরা মিলাবেন। নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমা আছে। এই মাসআলাগুলো আপনি দেখবেন সব জায়গায় একরকম। দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় মুসলিম উম্মাহ আছে  সবাই এগুলো একভাবে পালন করছে। দেখবেন, একবার রুকু করছে। কেউ একই রাকাতে দুইবার রুকু করছে না। হজ্বে যান, পূর্বদিকের কোনো দেশে যান, যেখানে যান দেখবেন রুকু একটা, সেজদা দুইটা। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস দেখবেন ব্যতিক্রম । যেমন এখানে দেখবেন সবাই আমীন বলছে। কিন্তু স্তে, অনুচ্চস্বরে বলছে। আমীন উচ্চারণ করছে, কিন্তু আওয়াজ ছাড়া উচ্চারণ করছে। যেমন আমরা নামাযে

 سبحان سبحان ربي العظيم ، سبحان ربي الأعلى، ربنا لك الحمد উচ্চারণ করি। কিন্তু উঁচু আওয়াজ ছাড়া উচ্চারণ করি। কিন্তু হজ্ব বা উমরায় গিয়ে দেখবেন ওখানে অনেকে জোরে আমীন বলে। আপনি আস্তে আমীনও দেখতে পেলেন, জোরে আমীনও দেখতে পেলেন-ঘটনাটা কী? এটা কি এমন যে, একটা বেদআত, একটা সুন্নাত? একটা বৈধ, আরেকটা অবৈধ। বিষয়টি কি এ রকম?

            আপনি যদি দু’শ কিতাব থেকে দু’হাজার হাদীস পড়েন, রুকু একটার কথাই পাওয়া যাবে। সেজদা দুইটার কথাই পাওয়া যাবে, একটার কথা পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমীনের ব্যাপারে হাদীসের যে কোনো বড় কিতাব আপনি খুলবেন, দু’ধরনের হাদীস পাবেন। এক ধরনের হাদীসে আমীন শব্দ করে বলার কথা আছে (চিৎকার করে নয়)। আরেক ধরনের হাদীসে আছে أخفى بها صوته নিঃশব্দে আমীন বলা।

            এক হাদীসে পাবেন শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠাবে, আর কোথাও হাত উঠাবে না। আবার আরেক হাদীসে পাবেন, রুকুতে যাওয়ার সময় হাত উঠাবে। রুকু থেকে উঠার পরে হাত উঠাবে। আরেক হাদীসে পাবেন, প্রতি তাকবীরে হাত উঠাবে। প্রতি উঠাবসায় হাত উঠাবে।

 في كل خفض و رفع           

এরকমভাবে তাকবীরে তাহরীমার পরে হাত বাঁধবেন কোথায়? নাভির উপরে কিংবা নাভির নিচে, দুটোই স্বীকৃত পদ্ধতি। এই যে বিভিন্নতা আমি দেখলাম এটার সমাধান কী?

            এটার সমাধান হল, যে এলাকায় যে হাদীসের উপর আমল হচ্ছে সেখানে সেই হাদীসের উপরই আমল হতে দিন। ওখানে আরেক হাদীসের তাবলীগ করবেন না। এখানে আসেত্ম আমীনের হাদীসের উপর আমল হচ্ছে, আপনি এসে বললেন, আরে হাদীসে পান নাই, জোরে আমীন বলতে হয়! শরীয়তের সমঝ যার আছে সে এটা করবে না।

            এক জায়গায় বেদআত হচ্ছে সেখানে এই ওয়াজ করুন, ‘বেদআত ছেড়ে সুন্নাতের দিকে আসুন’। কিন্তু এক জায়গায় এমন একটি আমল হচ্ছে, যেটা সুন্নাত, এর বিকল্প আরেকটি সুন্নাতও আছে, যেটার উপর হয়ত অন্য জায়গায় আমল হচ্ছে, সেখানে এ কথা বলা যায় না, ‘এ আমল ছেড়ে ঐ আমল করুন’। যেমন সৌদিতে জোরে আমীনের সুন্নাতের উপর আমল। আমরা কোনো সময় হজ্ব-উমরায় গিয়ে এই কথা বলি না যে আপনারা কেন জোরে আমীন বলছেন?

            এখানে আপনারা দু’একজন যারা জোরে আমীন বলছেন আপনারা যদি এই নিয়তে জোরে আমীন বলেন যে, এত মুসল্লী কেউ সুন্নাতের উপর আমল করছে না, আমি ছাড়া। তাহলে সুন্নাত পালন করে আপনি যতটুকু সওয়াব পাচ্ছেন, তারচেয়ে বেশি গোনাহ হয়ে যাচ্ছে অন্য মুসলস্নীদের ব্যাপারে কুধারণা করার কারণে।

            যদি জোরে আমীন বললে একটু বেশি সাওয়াব হত তাহলে আমরাই জোরে আমীনের উপর আমল শুরু করে দিতাম। কাজেই  কোনো চ্যানেলে একটি হাদীস শুনে কুধারণার শিকার হবেন না যে, আমাদের খতীব ছাহেব এতদিন আমাদেরকে এই হাদীস কেন শোনাননি? খতীব  এই বিষয়ের সব হাদীস অধ্যয়ন করেছেন। সবগুলোর সনদ বিবেচনা করেছেন। এরপর তিনি দেখেছেন, এ বিষয়ে ইমাম ইবনু জারীর ত্ববারী যা বলেছেন তা-ই সবচেয়ে শক্তিশালী কথা। তিনি ৩১০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর লেখা তাফসীর গ্রন্থ হল, তাফসীরে ত্ববারী এবং হাদীস গ্রন্থ হল, তাহযীবুল আছার। আরও কত গ্রন্থ রচনা করেছেন ইমাম ইবনু জারীর ত্ববারী। এগুলোর নাম বলার লোকও আজকাল পাওয়া যায় না। তিনি লিখেছেন,

والصواب أن الخبرين: بالجهر بها والمخافتة صحيحان، وعمل بكل من فعليه جماعة من العلماء وإن كنت مختارا خفض الصوت بها، إذا كان اكثر الصحابة والتابعين على ذلك           

‘সঠিক কথা হল, সশব্দে আমীন বলা, নিঃশব্দে আমীন বলা উভয় হাদীস সহীহ। তাঁর উভয় আমলকে আলেমগণের এক এক জামাত অবলম্বন করেছেন। আমি অবশ্য আস্তে আমীন বলাকেই অগ্রগণ্য মনে করি। কারণ অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ী এর উপর ছিলেন।’ -আল জাওহারুন নাক্বী : ২/৫৮

অধিকাংশ সাহাবী-তাবেয়ীর আস্তে আমীন বলার মানেই হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের বেশিরভাগ আমল ছিল, আস্তে আমীন বলা। এখানে এই নিয়মের উপর আমল হচ্ছে। এখন এক দুই ভাই জোরে আমীন সম্পর্কে এক দু’টি তথ্য শুনে যদি এখানকার আলেমদের সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করেন তাহলে কি তা ঠিক হবে? এভাবে অন্যের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করা আর নিজের ব্যাপারে সুধারণা রাখা ঠিক নয়।

            কয়টা হাদীসের কিতাব অনুবাদ হয়েছে? কত শত হাদীসের কিতাব এখনো অনুবাদ হয়নি। না ইংরেজিতে না বাংলাতে। দু’চারটা অনুবাদ পড়েই যদি মনে করি আমি আল্লামা হয়ে গেছি, তাহলে তো মুশকিল। আর যার জানা- শোনার ভিত্তিই হল ‘অনুবাদ’ সে কি অনুবাদের ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারবে?

            এ জন্য বলছিলাম, শুধু জানা যথেষ্ট নয়, ফিকহের প্রয়োজন। কোনো বিষয়ের এক দু’টি তথ্য জানা যথেষ্ট নয়, তার সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতিও বোঝা জরুরি। আর তা দ্বীনের সঠিক সমঝ ছাড়া কখনো সম্ভব নয়। শুধু এক দুই ক্ষেত্র নয়, আরো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে দ্বীনের সমঝের অভাবে তথ্য জানা সত্ত্বেও অনেকে ভুল বুঝাবুঝি ও প্রান্তিকতার শিকার হয়। তাই দ্বীনী সমঝ অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আর এ সমঝ শুধু কিতাব পড়ে অর্জন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন এমন সমঝের অধিকারী আল্লাহওয়ালা আলেমগণের সাহচর্য অবলম্বন। অল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন, আমীন।

শ্রুতিলিখন : রাইয়ান বিন লুৎফর রহমান

 

 

 

 

 

advertisement