মুহাররম ১৪৩৬   ||   নভেম্বর ২০১৪

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

প্রশংসার ক্ষেত্রে (২)

বর্তমানকালে সবকিছুই আর্ট বা শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। আল্লাহ তাআলা মানব-সত্তায় যে বহুমুখী প্রতিভা নিহিত রেখেছেন, নিত্য নতুন পন্থায় তা বিকাশ লাভ করছে। প্রতিভা-বিকাশের সে ডামাডোলে মানুষের কাছে লঘু-গুরুর প্রভেদও যেন ঘুচে গেছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কেও সে তার চর্চা ও পরিচর্যার স্পর্শে মনোযোগ-আকর্ষী শিল্পের স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। মানব-সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ও এখন আর শিল্পের আওতা-বহির্ভূত নয়। তা না-ই থাকুক। মানুষের হাতের ছোঁয়ায় নগণ্য সবকিছু প্রথম শ্রেণীতে গণ্য হয়ে উঠলে তাকে তো মানুষের কৃতিত্বই বলতে হবে। সুতরাং মানুষের জীবন সম্পর্কিত প্রতিটি জিনিস যদি শিল্প হয়ে ওঠে তা উঠুক না! আমরা তাকে সাধুবাদই জানাব। কেননা আমাদের শরীআত যে জীবনের নির্দেশনা দেয়, তাও তো শিল্পিত জীবনই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাচার ছিল শিল্পোৎকর্ষের সর্বোত্তম নিদর্শন। তাঁর শিক্ষায় আমরা অপরিহার্য সব কিছুর নিখুঁত ধারণ ও বাহুল্য সবকিছু বর্জনেরই সবক পাই। সেই সবক যে গ্রহণ করবে তাঁর হাসি-কান্না, চলন-বলন প্রভৃতি জীবনকৃত্য সুষমাম--ত হতে বাধ্য। তার প্রতিটি বিষয় হবে সুচারু ও শোভনীয়। কাজেই সাধনা-সেবা ও চর্চা-পরিচর্যা দ্বারা কোনও কিছুকে শিল্পমানে উন্নীত করার ভেতর এমনিতে কোনও দোষ নেই। তা দোষের হয় তখনই, যখন তাতে বৈধাবৈধের কোন বিচার থাকে না, সত্যাসত্যের ভেদাভেদ থাকে না এবং পারিপার্শ্বিক লাভ-ক্ষতির প্রতি কোনও ভ্রুক্ষেপ থাকে না। এই বেলাগাম লিপ্ততার কারণে অনেক সময় নন্দিত জিনিস নিন্দিত হয়ে যায় এবং বৈধ বিষয় অবৈধতায় পর্যবসিত হয়। যেই প্রশংসা সম্পর্কে আমরা আলোচনা করছি, এমনিতে তো তা একটি বৈধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাম্য জিনিস। তাই পূর্ণ মনোযোগের সাথে এতে লিপ্ত হওয়াতে কোনও দোষ নেই। বরং যথার্থ প্রশংসাকে ভাব-ভঙ্গী ও ভাষার মাধুর্যে মনোজ্ঞ করে তুললে তা কেবল প্রশংসিতের মনোরঞ্জনই করে না, প্রশংসার লক্ষ্যার্জনেও সহায়ক হয়। কিন্তু তা সহায়ক হয় ততক্ষণই, যতক্ষণ প্রশংসাকে শিল্পিতকরণের বাড়াবাড়ি দ্বারা বাস্তবতাবর্জিত অতিকথনে পরিণত করা না হয়। সন্দেহ নেই আজকাল তাই হচ্ছে এবং ভয়াবহরূপে হচ্ছে। সাধারণ-বিশিষ্ট অধিকাংশের দ্বারাই এই অনুচিত কর্মটি ঘটছে। বিশেষত দৃষ্টি যাদের শৈল্পিক বর্ণচ্ছটায় প্রশংসাকে কতটা ঝলমলে করে তোলা যায় এবং প্রশংসিত বা শ্রোতা সাধারণকে প্রশংসার যাদুকাঠি দ্বারা কতটা মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলা যায়, সে দিকেই নিবদ্ধ, তাদের হাতে পড়ে প্রশংসা নামক সুকুমার কর্মটি আজ চরমভাবে বিপন্ন। ক্ষেত্রবিশেষে সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করা খুব সহজ কাজ নয়।

  লিখন, কথন, পারস্পরিক আলাপচারিতা, সভা-সমাবেশের বক্তৃতা-বিবৃতি, ও সবরকম গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণায় ব্যক্তি বা বস্তুর গুণকীর্তন একটি নিত্যদিনের কর্মানুষ্ঠান। হরদম নানাপ্রকারে, বিচিত্র ভাব-ভঙ্গীতে এতে লিপ্ত হরেক রকম মানুষ। এর বিবিধ কার্যপ্রণালীর ফিরিস্তি দান করা এ স্থলে উদ্দেশ্য নয় এবং তা সম্ভবও নয়। কেবল মোটা দাগের কয়েকটি রসমী ও পেশাগত পদ্ধতির উল্লেখ করা যাচ্ছে, যাতে ব্যক্তি বা বস্তুর প্রশংসা শুধু উচ্ছ্বসিতভাবেই নয়; কোনওরকম সত্যাসত্যের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছভাবে করা হচ্ছে।

  সংবর্ধনা ও মানপত্র

  গুণী ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দেওয়ার রেওয়াজ বহুদিনের। বর্তমানে এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। এখন সংবর্ধিত হওয়ার জন্য গুণী হওয়ার দরকার পড়ে না। অর্থ ক্ষমতাও সংবর্ধনাকে আকর্ষণ করে। গুণ অপেক্ষা একটু বেশি পরিমাণেই করে। কারণ এর সাথে প্রভাব-প্রতিপত্তি জড়িত। সংবর্ধনা যেন প্রভাবশালীর হক। তাই এ হক আদায়ে প্রভাববলয়ের সকলে থাকে বেজায় ব্যস্ত, তা অন্যসব হক অর্থাৎ শরীআত-নির্ধারিত হক আদায়ে যতই নির্লিপ্ত থাকুক না কেন।

  যা-হোক সংবর্ধনা সায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে মানপত্র দেওয়া হয় ভায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে মানপত্র দেওয়া হয় এবং বক্তাগণ তার গুণকীর্তনে একের পর এক বক্তৃতা দিতে থাকে। তাতে যা লেখা বা বলা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না। মানপত্রের রচয়িতা ও বক্তা প্রত্যেকেরই নজর থাকে নিজ দক্ষতা জাহির করার দিকে। সেইসঙ্গে উদ্দেশ্য থাকে খোশামোদ করাও। তাই যা বলা হচ্ছে তা আদৌ সত্য কি না বা তার সাথে সেই ব্যক্তির দূরেরও কোন সম্পর্ক আছে কি না তা ভেবে দেখার কোনও প্রয়োজনই বোধ করা হয় না। ফলে লিখিত ও উচ্চারিত সবটাই হয় কুরআন মাজীদের ভাষায় زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا প্রতারণামূলক চমকপ্রদ বাক্য (আনআম : ১১২)। ব্যক্তিটির মধ্যে যদি কিছুটাও আত্মসচেতনতা থাকে এবং থাকে আল্লাহর ভয়, তবে সেসব বাক্যের অসারতা ঠিকই বুঝতে পারে। যদ্দরুন সে কুণ্ঠিত ও বিব্রত হয়। ভেবে শিউরে ওঠে যে, আমি কী আর বলা হচ্ছে কী!

এমনকি অনেক সময় তজ্জন্য নিজেকে অপমানিতও বোধ করে। কেননা ব্যক্তির সাথে প্রশংসাবাক্যের তফাত দৃষ্টিকটু রকমের হলে তা আর প্রশংসা থাকে না, ব্যঙ্গে পরিণত হয়ে যায়। ভরা-মজলিসে ব্যঙ্গ-উপহাসের শিকার হলে আত্মম্মানবোধসম্পন্ন যে-কোনও লোকই নিজেকে অপমানিত বোধ করবে। কী লোমহর্ষক পরিহাস! সম্মাননার শিরোনামে এতসব আয়োজন, অথচ বাস্তবে হচ্ছে চরম অবমাননা। কিন্তু আয়োজকের সে অনুভূতি কোথায়? ব্যঙ্গাত্মক বাক্যবাণে একজনকে জর্জরিত করা হচ্ছে, অথচ তারা এই ভেবে আহ্লাদ বোধ করছে যে, কি অভূতপূর্ব সম্মাননা তাকে দান করলাম! এটা একরকম আত্মপ্রবঞ্চনাও বটে। চরম গর্হিত কাজ করে ভাবা হচ্ছে বেজায় ভালো কাজ। তবে এ জাতীয় অতিরঞ্জনে যারা খুশি না হয়ে লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হয় কিংবা অপমানিত বোধ করে তাদের সংখ্যা বড় কম। দ্বীনদারী ও আল্লাহভীতির অভাবে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতি হারিয়ে যায়। অর্থ ও সম্মানস্পৃহা মানুষকে স্থূলমতি করে তোলে। জড়বাদ-অধ্যুষিত আধুনিক বিশ্ব তো সেই স্পৃহায় কাতর। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই এখন স্তবপ্রত্যাশী। তাতে যত অত্যুক্তিই হোক না কেন, তাকে তারা অসংগত মনে করে না। বরং খুশিই হয় এবং মনে মনে স্তবককে বাহবা দেয়। এতে প্রশংসাকারী ও প্রশংসিত ব্যক্তির যে ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা হয়েছে।

  অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাতীয় সংবর্ধনার পেছনে উদ্দেশ্য খুব সৎ থাকে না। লÿ্য টাকা-পয়সা বা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা। এভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কারও থেকে অন্যায় সুবিধা ভোগের কোনও বৈধতা ইসলামে নেই। এক হাদীসে ইরশাদ-

 إن الله يبغض البليغ من الرجال الذي يتخلل بلسانه تخلل الباقرة بلسانها আল্লাহ তাআলা সেই বাগ্মী পুরুষকে ঘৃণা করেন, যে তার জিহবা (অর্থাৎ বাকচাতুর্য) দ্বারা খায় (অর্থাৎ রোজগার করে), যেমন গরু তার জিহবা দ্বারা খেয়ে থাকে (সুনানে আবূ দাঊদ, হাদীস ৫০০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৫৩)। এ হাদীস মুখের যে কোনও অপব্যবহার দ্বারা পার্থিব সুবিধা ভোগকে অবৈধ ঘোষণা করছে। অনস্বীকার্য, প্রশংসার বাড়াবাড়িও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সংবর্ধনা ও মানপত্র দানের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোনও রকম অসদুদ্দেশ্যকে এতে প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। উদ্দেশ্য সৎ থাকার পরও অসত্য কথন ও অতিরঞ্জনকে পরিহার করতে হবে। সেই সঙ্গে সঠিক প্রশংসা বাক্যও যদি কারও পক্ষে ক্ষতিকর মনে হয় তাও পরিত্যাজ্য।

  চরিত্রসনদ

  সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চরিত্রসনদকে মূল্য দেওয়া হয়। তাছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন কাজে এর প্রয়োজন পড়ে। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ এ সনদ দিয়ে থাকেন এবং তাদের দেওয়া সনদ অনুযায়ী সনদবাহী ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সুতরাং এটা একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজ। একাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু দেওয়া হয়? পরিচিত-অপরিচিত যে কেউ আসে, লিখে দেওয়া সে আমার পরিচিত। সে দেশের একজন সুনাগরিক ও চরিত্রবান লোক। ক্ষেত্রবিশেষে আরও অনেক কিছু লেখা হয় ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। অপরিচিত লোককেও যদি পরিচিত বলে চালানো হয় তাতে সনদদাতার সত্যনিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ থাকে কি? তারপর যদি কারও সম্পর্কে বেশি কিছু না বলে কেবল এতটুকুই বলা হয় যে, সে একজন সুনাগরিক ও চরিত্রবান লোক প্রশংসা হিসেবে তা কি কম কিছু?  দেশের জন্য কারও সুনাগরিক হওয়াটা তো চারটিখানি কথা নয়। এর জন্য যে দায়বদ্ধতা ও কল্যাণচিমত্মার দরকার তা ঠিক কতখানি আমাদের মধ্যে আছে? দেশ ও দেশাত্মবোধের জিগির তো সবার মুখে মুখে, কিন্তু দেশের জন্য সত্যিকারের মমতা কতজন পোষণ করে। অন্ততপক্ষে আমার কোনও কাজ যাতে দেশের জন্য ক্ষতিকর না হয়, এতটুকু সচেতনতাই বা কজনের আছে? কাজেই সুনাগরিক হওয়া খুব সোজা কথা নয়। তারপর কারও চরিত্রবান হওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। চরিত্র নবী-রাসূলগণের শিক্ষার একটি প্রধান ধারা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, بعثت لاتمم مكارم الأخلاق আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতাবিধানের জন্য। মানবচরিত্রের বহু দিক আছে। তার সবগুলোতে যে শূচিশুদ্ধ, সে-ই চরিত্রবান। কে সত্যবাদী, আমানতদার, বদান্য, বিশ্বস্ত, সরল ও অকপট, উদারপ্রাণ, ক্ষমাপ্রবল, সহনশীল ও নিঃস্বার্থ তার কতটুকু আমরা জানি? সুতরাং নিশ্চিত না হয়ে নিশ্চিতমনে কাউকে চরিত্রবান বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া যায় কি করে? তা দিতে গেলে তো নিজেরই চারিত্রিক শুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায় এ সনদের পেছনে কোনও রকম লেন-দেনের ব্যাপার নেই তো? কিংবা কাজ করেনি তো কিছুটা স্বজনপ্রিয়তা? আর কিছুও যদি না থাকে তবে দায়িত্বজ্ঞানের অভাব বলে অভিযোগ আসবেই। যেভাবেই হোক না কেন, নিশ্চিতভাবে না জেনে কাউকে চরিত্রসনদ দিলে তাতে সংশ্লিষ্টজনদের সাথে এক রকম খেয়ানত হয়ে যায়। কখনও বা জাতির সাথেও। কাজেই চরিত্রসনদ দিতেও সাবধানতা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মধ্যম পন্থা হল অজ্ঞাত কাউকে চরিত্রসনদ না দেওয়া। আর যাদের সম্পর্কে জানা আছে তাদেরকে সতর্কতার সাথে দেওয়া। মুখস্থ শব্দ না আউড়িয়ে যার সম্পর্কে যতটুকু জানা থাকে ঠিক ততটুকুই লেখা।

  বই-পুস্তক সম্পর্কে অভিমত

  বিভিন্ন বই-পুস্তক খুললে শুরুতেই দেখা যায়, বইটি সম্পর্কে বিশিষ্ট ও বিখ্যাত কারও অভিমত ছেপে দেওয়া হয়েছে। কখনও তারই হস্তান্তরে কখনও মুদ্রিতাকারে। কোনও বইতে দু-একজনের অভিমত, কোনওটায় বহুজনের। এমন বইও চোখে পড়েছে, যার গোটা একটা ফর্মাই চলে গেছে অভিমতের দখলে। মূল বইতে পৌঁছাতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাতে হয়। সে এক ক্লান্তিকর অভিযাত্রা। 

  যাহোক বইয়ের শুরুতে অভিমত ছাপানোটাও এমন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। এমনিতে এটা দোষের কিছু নয়। লেখক তার রচনার বিশ্বস্ততাকে বিশ্বাস করানোর জন্য বা তার প্রতি পাঠক সাধারণের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বরেণ্য কোনও ব্যক্তির অভিমত জুড়ে দিতেই পারে। কিংবা এর উদ্দেশ্য কেবল বরকত লাভও হতে পারে। থাকল তার রচনার শুরুতে কোন বুযুর্গ ব্যক্তির দুটি কথা। হয়ত সেই বরকতে রচনাটি মানুষের সমাদর লাভ করবে বা অন্য কোন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করবে। সুতরাং অভিমত ছাপানোতে আপত্তিকর কিছু নেই। যে কারণে বিষয়টির অবতারণা, তা হচ্ছে অভিমতের ভাষা।

প্রায় সব অভিমতেই থাকে রচনার প্রশংসা এবং কেবলই প্রশংসা। কখনও কদাচিৎ সাদামাঠা ভাষায়, অধিকাংশই উচ্ছ্বসিতভাবে।

  ক্ষ্য করলে দেখা যায়, অভিমতযুক্ত রচনাবলীর মধ্যে এমন এমন বইও থাকে রচনার দিক থেকে যা শিল্পমানে উত্তীর্ণ নয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রচনা ও সংকলন একটি উচ্চ পর্যায়ের শিল্প। একটি মানসম্পন্ন রচনার জন্য তথ্য সমৃদ্ধি, বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গতা, উপস্থাপনার বলিষ্ঠতা, আলোচনার ধারাবাহিকতা, সুষ্ঠু বিন্যাস, ভাষার মাধুর্য ও গতিময়তা অনেক কিছুই দরকার। (স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এসব অনুষঙ্গের সাথে কিঞ্চিৎ পরিচিত থাকলেও আজও পর্যন্ত এতে আমার দখল আসেনি। যে কারণে একটি শিল্পমানসম্পন্ন রচনা তৈরি করে ফেলার মত দুরাশা আমি করতে পারি না। তবে যারা তা করতে পারে এবং যথারীতি তাদের অগ্রযাত্রা শুরুও হয়ে গেছে, সংখ্যায় কম হলেও আলহামদু লিল্লাহ এরকম কলমশিল্পীদের অস্তিত্ব আমরা মুগ্ধ চোখে দেখতে পাচ্ছি। সেদিন হয়ত দূরে নয় যখন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এর প্রয়োজনীয় সংখ্যা পূরণ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তা পূরণ করেই দিন- আমীন)

  যাহোক বলছিলাম, মানসম্পন্ন রচনার আনুষঙ্গিক বিষয় অনেকগুলো। কিন্তু অনেক বইতেই তার বেশিরভাগ থাকে না বা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকে না। তা সত্ত্বেও তাতে বিশিষ্টজনদের অভিমত ছেপে দেওয়া হয় এবং সাধারণত সে সব অভিমতে বইয়ের প্রশংসাই করা হয়ে থাকে। এটা যেমন পার্থিব বিষয়াদি সংক্রান্ত রচনায় করা হয়, তেমনি দ্বীনী বই-পুস্তকেও।

  কোনও বই সম্পর্কে অভিমত দেওয়াটা সেই বই সম্পর্কে সাক্ষ্যের মর্যাদা রাখে। এটা এক ধরনের তাসদীক (সত্যায়ন) ও তাওছীক (বিশ্বস্ততা নিরূপণ)-ও বটে। এর মাধ্যমে অভিমতদাতা পাঠক সাধারণের সামনে বই সম্পর্কে তার মূল্যায়ন তুলে ধরেন। বইটি সম্পর্কে নিজ মতামত ব্যক্ত করেন এবং এর বিশুদ্ধতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সাক্ষ্য দান করেন। এর ফলে বইটির উপর পাঠকের আস্থা জন্মায় এবং তাতে উপস্থাপিত তথ্যাবলী ও বিষয়বস্তু গ্রহণে উৎসাহী হয়। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এটা অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজ। কেননা বইতে যদি কোন ভুল তথ্য থাকে এবং সেই আস্থার ভিত্তিতে পাঠক তা গ্রহণ করে নেয় তবে তাতে তার ও সংশ্লিষ্ট সকলের যে দ্বীনী ও দুনিয়াবী ক্ষতি সাধিত হবে তার দায়ভার কেবল লেখকের উপরই নয়, অভিমতদাতার উরপও বর্তাবে। এ কারণেই আমাদের আকাবিরে দ্বীন (দ্বীনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ) এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাদের অভিমতসমূহ (তাকরীয) পাঠ করলে লক্ষ্য করা যায়। শব্দ প্রয়োগে তারা কতটা সতর্ক ছিলেন। রচনার মান এবং তাদের কর্তৃক তা পাঠ সম্পর্কে তাদের শব্দ হত অত্যন্ত মাপাজোখা। বর্তমানকালের আকাবিরে দ্বীনও এক্ষেত্রে তাদের পদাঙ্কানুসারে চলে থাকেন। কিন্তু সাধারণ চিত্র এরকম নয়। অধিকাংশ অভিমতেই দায়িত্বজ্ঞানের ছাপ থাকে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অভিমত যেন সর্বাবস্থায় প্রশংসামূলকই হতে হয়, তাতে রচনার মান যাই হোক না কেন। কি মৌলিক রচনায়, কি অনুবাদে সর্বত্রই অভিন্ন দৃশ্য। মূলের সাথে অনুবাদের দুস্তর ব্যবধান, কিন্তু উচ্চ প্রশংসার সাথে বলা হয়, অনুবাদ সম্পূর্ণ মূলানুগ। মৌলিক রচনায় তথ্যভুক্তিতে সতর্কতার অভাব, অথচ বলে দেওয়া হয়, অত্যন্ত সারগর্ভ তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রমাণসমৃদ্ধ রচনা। ভাষা সুখপাঠ্য, এমনকি বিশুদ্ধ না হলেও অভিমতে তা মানোত্তীর্ণ হয়ে যায়। এবংবিধ আরো বহু শিথিলতায় বর্তমানকালের অভিমত তার ওজন হারাতে বসেছে। দরকার ছিল গুণ ও দোষ দুটোই সামনে রাখা এবং গুণের জন্য প্রশংসার পাশাপাশি ত্রম্নটিকেও নিশানদিহী করে দেওয়া। এটা হত সত্যিকারের আমানতদারি। সে ক্ষেত্রে সতর্ক পাঠক অভিমত ও রচনায় সাযুজ্য পেত। গরমিলের জন্য ধাক্কা খেত না। কিন্তু সেই সাবধানতা অবলম্বন না করায় এবং প্রান্তিকতামূলক প্রশংসাপত্র লিখে দেওয়ায় একদিকে সতর্ক পাঠক হোচট খাচ্ছে, অন্যদিকে যাদের সচেতনতার অভাব বা যারা লেখক বা অভিমতদাতার প্রতি অতি আস্থাশীল তারা হচ্ছে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। এসবই প্রশংসায় বাড়াবাড়ির কুফল। এ কুফল থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা করার জন্য দরকার প্রশংসায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া তথা আকাবিরে দ্বীনের মতো অভিমত দানে সতর্কতা অবলম্বন করা, যেমন দ্বীনী রচনাবলীতে তেমনি দুনায়াবী বইপুস্তকের ক্ষেত্রেো

  পণ্য বিজ্ঞপ্তি

  প্রচারেই প্রসার একটি সর্বজনবিদিত মূলনীতি। পণ্যের ক্ষেত্রেই এটা বেশি প্রযুক্ত হয়ে থাকে। পণ্যের ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্য উৎপাদক মহল প্রচার-প্রচারণাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর জন্য বিজ্ঞাপন ও মডেলিংয়ের মত নতুন নতুন শিল্প ও পেশার উদ্ভব ঘটেছে। এর মাধ্যমে পণ্যের গুণকীর্তণ করে ভোক্তাসাধারণকে আকৃষ্ট করাই উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যখন তাদেরকে আকৃষ্ট করে পণ্যটি তাদের গছিয়ে দেওয়া তাই বাস্তবে সেটি যেমনই হোক না কেন বিজ্ঞাপিত করা হয় অতি উপকারী একটি সংগ্রহযোগ্য বস্তুরূপে। এ পেশায় যারা আত্মনিয়োগ করে, অর্থ বিত্তই যেহেতু তাদের মূখ্য তাই একেকটি পণ্যকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য নিজেদের সবটা ক্ষমতা ঢেলে দেয়। প্রতিযোগিতার বাজারে নিজ নিজ মক্কেলের পণ্যটিই যে সবার সেরা তা প্রতিপন্ন করার জন্য তদসংশ্লিষ্ট যত গুণ আছে সবই তাতে একঠাঁই করার কসরত করে। এ প্রচেষ্টায় যে যতটা দক্ষতা দেখাতে পারে সে ততটা প্রতিষ্ঠা পায়। সেই প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে ভাষা-ভাব-ভংগী ও অভিনয়ের মাধ্যমে পণ্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, মনে হয় তার চেয়ে খাসা মাল যেন আর কিছু হতে পারে না। প্রশংসার জগতে বোধ করি এর চে শিল্পিত (?) ও এর বেশি অতিরঞ্জিত প্রশংসা আর কিছুরই হয় না। এই প্রশংসায় কেবল ভাষাই ব্যবহার হয় না, প্রশংসাকারীর গোটা সত্তাই এতে বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে যেখানে পৌঁছানো হয়, বাস্তবিকই কি পণ্যটি সেই মানের এবং আসলেই কি সেটি সেই সব গুণের ধারক? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো বিশেষজ্ঞগণ তা স্বীকার করেন না। তাহলে সে প্রশংসা ও প্রচারণা মিথ্যাচারের মধ্যে পড়ে না কি? আজ এই মিথ্যাচারের মাধ্যমে গোটা জাতিকেই তো প্রতারিত করা হচ্ছে। মিথ্যাচার ও প্রতারণা দুটোই গুরুতর মহাপাপ। প্রতারণা যে কতটা গুরুতর গুনাহ তা বোঝার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সাবধানবাণীটিই যথেষ্ট যে, তিনি বলেন, من غشنا فليس منا যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে সে আমাদের একজন নয়। অথচ এই প্রতারণাই আধুনিককালের এক ফ্যাশন ও শিল্পের রূপ ধারণ করেছে আর এর ফাঁদে ফেলে গণমানুষকে যতসব ভেজাল পণ্যের ভোক্তা বানানো হচ্ছে। আজ গণস্বাস্থ্য যে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন, কে না জানে এই ভেজাল ভোগই তার জন্য বড় দায়ী। এর থেকে মুক্তির জন্য যে পরিব্যাপ্ত সচেতনতা দরকার তার অংশ হিসেবে প্রশংসা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভংগীকে অবশ্যই সামনে নিয়ে আসতে হবে। ভেজাল পণ্যের প্রশংসা অথবা নির্ভেজাল পণ্যেরও অতি প্রশংসা, কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিত্রুটিকে পাশ কাটিয়ে কেবলই গুণকীর্তনের একদেশদর্শিতা যে বহুবিধ পাপের সমষ্টি সেই বোধ যদি মানুষের চেতনায় জাগ্রত হয়ে যায়। তবেই ব্যবহারিক, চারিত্রিক সকল অংগনে হাজারও ক্ষতি থেকে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

advertisement