মুহাররম ১৪৩৬   ||   নভেম্বর ২০১৪

তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-৩

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

***

বিমানের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, সউদিয়ার বিশাল আকাশযান হাজী ছাহেবানদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এবং রানওয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। বিমান বাংলাদেশের একটি বিমান তখনো ব্রিজের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত হাজী ছাহেবান আরোহণ করছেন। তাদের উড়াল হবে আমাদের পরে। ডানদিকে তাকিয়ে দেখি, সউদিয়া দৌড় শুরু করেছে। এমন সময় আর কখনো মনে পড়েনি, এবারই মনে পড়লো কোরআনের আয়াত-

وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّموَاتُ وَالْأَرْضُ

তোমরা দৌড় লাগাও তোমাদের প্রতিপালকের মাগফিরাতের দিকে এবং জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা হলো আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সমান।

মনে মনে দুআ করলাম, বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের হে মোবারক জামাত, আল্লাহর ঘরের দিকে, রাবের মাগফিরাতের দিকে এবং জান্নাতের দিকে তোমাদের  দৌড় আল্লাহ কবুল করুন।

মনে আকাঙ্ক্ষা ছিলো, বিমান  বাংলাদেশের দৌড়টাও যদি দেখে যেতে পারতাম! মনেই ছিলো, মুখে বলিনি, কিন্তু যিনি শোনেন, তিনি তো মনের কথাও শোনেন এবং দিলের খবরও জানেন! তিনি দয়া করলেন; আমার মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো। কী এক কারণে জেট এয়ার উড়াল দিতে কিছুটা দেরী করলো, আর বিমান বাংলাদেশ চলতে শুরু করলো। একসময় স্থির হলো, তারপর শুরু করলো

উড়ালপূর্বদৌড়। মনের অবস্থা তখন কেমন হলো, ভাষায়

প্রকাশ করার সাধ্য নেই। শুধু বলতে পারি, আমার দিলটাও যেন দৌড় দিলো, কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছার আগেই বিমান আকাশে উড়াল দিলো। আমি শুধু হাসরতভরা[1] নযরে দূর আকাশে বিমানের মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম।

সউদিয়া প্রতিটি উড্ডয়নের সময় দুআ পড়ে-

سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ ، وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ

পবিত্রতা বর্ণনা করি ঐ মহান সত্তার যিনি আমাদের জন্য বশীভূত করেছেন এটিকে, ...

তারপর পড়ে এই দুআ-

اللهُمَّ إنَّا نّسْأَلُكَ فِيْ سَفَرِنَا هذا البَرَّ والَّتقْوى ...

কিন্তু আমরা তো চড়েছি বন্দে মাতরম-এর জাহাযে। আমাদের সে ভাগ্য হবে কোত্থেকে! আমাদের ভাগ্যে জুটলো শুধু একটা শুকনো সোয়াগাত, আর আশা হ্যয় কি আপ কি য়াত্রা স্যফল র‌্যহেগী[2]

জেট এয়ার চলতে শুরু করলো, আমরা দুআ পড়ে নিলাম। আপাতত গন্তব্য আমাদের দিল্লী; আকবর, হুমায়ূন, শাহাজাহান ও আওরঙ্গযেব-এর দিল্লী, লালকেল্লা ও কুতুবমিনারের দিল্লী এবং হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ.-এর দিল্লী, যদিও আমাদের আবদ্ধ থাকতে হবে বিমানবন্দরের সীমানায়।

***

দেশের ভূমিকে আকাশ থেকে আগেও দেখেছি; আজ যেন নতুন করে দেখা হলো। এতদিন দেখেছি আল্লাহর ঘরে যাওয়ার পথে এবং আল্লাহর ঘর থেকে ফেরার পথে। তখন সৌন্দর্য অবলোকন করা হতো, উপভোগ করা হতো না। তখন তো মনের ভাব ও ভাবনা হয় অন্যরকম। আজ যেন আমার দেশের সবুজকে, জল ও জলাভূমিকে, গ্রাম ও নদ-নদীকে অন্যভাবে অনুভব করলাম, আর মনটা খুব বিষণ্ণ হলো। সবাই যাকে বলে কবিদের গুরু তিনি বলেছেন, সোনার বাংলাকে তিনি ভালোবাসেন। সেই বাংলা এখন সোনার কি না, মাঠে মাঠে এখন সোনার ফসল ফলে কি না; পদ্মার ঢেউ দেখে জেলেদের এখন বুক কাঁপে কি না, জালে এখন ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ ওঠে কি না, জানি না। তবু মনে হলো, আকাশ থেকে দেখা এই যে দেশটি, এ আমার দেশ, এখন যার নাম বাংলাদেশ! কবি এ দেশকে মা বলে ডেকেছেন, আর বলেছেন, বাংলামায়ের বদনখানি মলিন হলে তাঁর নাকি প্রাণ কাঁদে। হয়ত তাই, কবিদের গুরু হয়ে তিনি কি আর মিথ্যা বলবেন!

তবে কবি সাহেব যদি আজ বেঁচে থাকতেন, বলতাম, মহাশয়, বাংলাদেশ বিমানে না হোক, এয়ার ইন্ডিয়ায় একবার আরোহণ করুন এবং এটাই যদি হয়ে থাকে আপনার মা, আপনার সোনার বাংলা তাহলে জানালা দিয়ে একটু নীচের দিকে দেখুন, ফারাক্কার অভিশাপে বাংলামায়ের বদনখানি আজ কত মলিন! দেখুন, নদীগুলো শুকিয়ে কেমন জীর্ণ শীর্ণ! আপনার গাঁয়ের ছোট নদীতে বোশেখমাসে হাঁটুজল ছিলো, সেই হাঁটুজল এখন পদ্মায়; হাঁ, সেই পদ্মা যার বুকে বোট ভাসিয়ে আপনি কবিতা লিখেছেন। সত্যি যদি আপনার প্রাণ কাঁদে তাহলে নিবেদন করি

বাবু! চোখের জলে আজ একটি নতুন কবিতা লিখুন এবং যারা আপনার মায়ের বদনখানি এমন করে মলিন করেছে তাদের অভিশাপ দিন।

আমার চোখে সত্যি সত্যি পানি এসে গেলো। সেদিনের সবুজশ্যামল বাংলাদেশের আজ এ কেমন ধূসর ছবি! জীর্ণ মলিন জমি ও জনপদ; জলহীন নদী ও শুকনো খালবিল, তবু মনে হলো সুন্দর! অপূর্ব সুন্দর! হে আল্লাহ, আমার দেশকে পানি দাও, আকাশ থেকে; ফল ও ফসল দাও, ভূমি থেকে। আমার দেশের মানুষকে শান্তি দাও, সচ্ছলতা দাও, আর তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার যোগ্যতা দাও, আমীন।

***

নীচে ভূমির সবুজে, উপরে আকাশের নীলিমায় তন্ময় ছিলাম। ধীরে ধীরে দেখি ভূমিতে  কমে আসছে সবুজের প্রাচুর্য এবং কমে আসছে আকাশে মেঘের আল্পনা। এর মানে হলো, আমরা বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে এসেছি। অবশ্য আমি এখানে একাত্তরে অর্জিত বাংলাদেশের কথা বলছি না, বলছি সেই অখণ্ড বাংলাদেশের কথা যা কলকাতার দাদাবাবুরা চাইলে সাতচল্লিশে খুব সহজেই আমরা অর্জন করতে পারতাম। তাহলে দাদাবাবুরা আজ ভারতের একটি অবহেলিত প্রদেশের বাসিন্দা না হয়ে হতে পারতেন স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। কিন্তু দাদাবাবুরা তখন বাংলাকে ভাগ করেই ছাড়লেন। এতেই নাকি তারা খুশী! অথচ এই বাবুরাই আগের বার বাংলাভাগের সময় তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বাংলাভাগ রদ করে তবে ক্ষন্ত হয়েছিলেন! রবীবাবু নাকি সে উপলক্ষেই সোনার বাংলা গানটি লিখেছিলেন, আর সেটাই এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত!

***

আকাশে এখন মেঘের খেলা নেই, ভূমিতে নেই সবুজের মেলা, আছে শুধু অন্তহীন মরুভূমি। অবশ্য স্বীকার করতেই হয়, মরুভূমিরও রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। বালুর ঢেউগুলো দেখতে সত্যি অপূর্ব! যেন নিপুণ কোন শিল্পীর হাতে তৈরী।

তন্ময়তাটা কেটে গেলো মাওলানা আব্দুল মতীন সাহেবের ডাকে। বিমানবালা খাবার নিয়ে হাজির। আচ্ছা, দাদাবাবুরা তাহলে দুপুরের আতিথ্যও করবেন! কে এক পর্যটক কোথায় যেন লিখেছিলো, পিরিচে এক আস্ত বিস্কুট দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানবালা নাকি মনোহর হাসি হেসে বলেছিলো, বিস্কুট কিন্তু পুরোটাই খেতে হবে!

সন্দেহ নেই নিছক পর্যটকীয় রসিকতা। কারণ দুপুরের খাবার যা দেয়া হলো তা ঠিক মধ্যাহ্ণভোজ না হলেও নেহাত মন্দ ছিলো না। একটা ভালো জিনিস দেখলাম এই প্রথম, জিজ্ঞাসা করছে, শাকাহারী কি না। আমীর ছাহেব সবজির কথা বললেন। তাই দিলো। আমাদের পাশের সারিতে আমিষভোজী। তাদের দেয়া হলো গোশত অথবা মাংস । সেটা গরুর যে নয় তা তো জানা কথা। কিসের কে জানে?! ভাবতেই গাটা কেমন গুলিয়ে উঠলো। আমার ইচ্ছে ছিলো সঙ্গে আনা খাবার খাবো এবং আল্লাহর রহমতে রুটি ও গোশত এত প্রচুর ছিলো যে, মুজতবা আলীর ভাষায়, এক বেলা রুটি-গোশত এবং এক বেলা গোশত-রুটি খেলেও শেষ হতো না। কিন্তু আমীর ছাহেব আবার বিজ্ঞ মুফতী, সুতরাং তাকে অনুসরণ করাই উত্তম। তাছাড়া শুনেছি, আলী মিয়াঁ রহ. এবং আসআদ মাদানী রহ. এয়ার ইন্ডিয়ার নিরামিষ আতিথ্য গ্রহণ করতেন।

***

খাওয়ার পর আমীর ছাহেব ও মাওলানা আব্দুল মতীন ছাহেব চোখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করার দুটি অর্থ আছে, তবে বলাবাহুল্য, এখানে তা প্রথম অর্থে বলা হয়েছে; অর্থাৎ তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার চোখে ঘুম নেই; সঙ্গে আছে একটি বই তুরস্কের ইতিহাস। তাই সেটা পড়ায় মন দিলাম। এখন নাম মনে নেই, জনৈক বিখ্যাত পর্যটক একটি সুন্দর পরামর্শ দিয়েছেন, পর্যটকরূপে কোন দেশে যাওয়ার আগে সে দেশের ইতিহাস জেনে নেয়া ভালো; তাতে ভ্রমণটা শুধু ভ্রমণ থাকে না, হয়ে যায় পরিভ্রমণ।

তুরস্কে আমি তো শুধু পর্যটক নই, আমি তো তুর্কিস্তানের সন্ধানী। সুতরাং আমার জন্য বিষয়টি রীতিমত কর্তব্য। একারণেই বইটি সঙ্গে নিয়েছি।

মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে এমনই ছিলো আমার জ্ঞানের বহর যে, শুরুতে যখন উছমানী খেলাফত শুনতাম, ভাবতাম, হযরত উছমান রা.-এর কোন বংশধর ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা, তাই বলা হয় উছমানী খেলাফত। অনেক পরে এ ভুল ধারণার নিরসন হয়। আসল ঘটনা এই যে, মধ্য এশিয়ার তুর্কিজাতির একটি শাখা ছিলো ওগোজ। ওগোজগোত্রের জনৈক ব্যক্তি তুগ্রম্নল কিছু অনুচরসহ ভাগ্যের সন্ধানে বের হয়ে বর্তমান আঙ্কারার নিকটবর্তী স্থানে এসে উপনীত হন। এসময় তিনি দেখতে পান, একদল তুর্কী সৈন্য যুদ্ধে পরাজয়ের সম্মুখীন। দুর্বলের প্রতি সহানুভূতি হিসাবে তুগ্রম্নল তার দলসহ তুর্কী সৈন্যদের পক্ষে যোগদান করেন এবং প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। সৈন্যদলটি ছিলো সুলতান কায়কোবাদের বাহিনীভুক্ত। সুলতান পুরস্কারস্বরূপ তুগ্রম্নলকে সুগুত নামক বিরাট একটি জনপদ জায়গীররূপে দান করেন। এখানেই ১২৫৮ সালে তুগ্রম্নলের পুত্র ওছমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি সুগুত-এর শাসনভার গ্রহণ করেন এবং আশেপাশের জনপদে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। সাহসে, প্রজ্ঞায়, দয়া ও কোমলতায় এবং ন্যায়পরতা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে সে যুগে তাঁর কোন তুলনা ছিলো না। তাই তিনি সাধারণ মানুষের নিঃশর্ত ভালোবাসা ও আনুগত্য লাভ করেন। এই ন্যায়পরায়ণ শাসক ওছমানের হাতেই মূলত তুর্কীদের নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সেটাকে বলা হতো উছমানী সালতানাত, ইউরোপের লোকেরা মুখটাকে কতকটা যেন ইচ্ছে করেই বাঁকা করে বলে, অটোম্যান এ্যম্পায়ার। অনেকেরই হয়ত জানা নেই, অটোম্যান হচ্ছে ইউরোপীয়দের মুখে উছমানী-এর বিকৃত রূপ।

পরবর্তীকালে তুর্কী সুলতানগণ খলীফা উপাধি গ্রহণ করার পর থেকে উছমানী খেলাফত শব্দটির প্রচলন হয়। উছমান দীর্ঘ সাতাশ বছর শাসন পরিচালনা করেন। তারপর একে একে ৩৬ জন সুলতান সুদীর্ঘ ৬৫০ বছর ধরে রাজত্ব করেন। শেষ খলীফা ছিলেন দ্বিতীয় আব্দুল মজীদ। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল পাশা ১৯২৪ খৃস্টাব্দের তেসরা মার্চ উছমানী খেলাফতের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এ দিনটি ছিলো চরম দুর্যোগের দিন। আল্লাহ জানেন, কবি ইকবাল কত দরদ-ব্যথা নিয়ে বলেছেন-

একটানে তুর্কী নাদান ফেড়ে ফেললো খেলাফতের লেবাস/ দেখো আপনজনের সরলতা, আর শত্রুজনের চতুরতা!

***

বইটা বন্ধ করে আবার জানালা দিয়ে নীচে তাকালাম। দেখা গেলো দিগন্ত বিসত্মৃত মরুভূমি, তবে আরবের মরুভূমির মত বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। পাহাড়ও দেখা গেলো এবং এত উপর থেকেও মনে হলো গম্ভীর, তবে হিজাযের মত ভাবগম্ভীর নয়। কে জানে হয়ত চোখের দৃষ্টিতে মনেরই ভাবের ছায়াপাত ঘটে!

উপরে আকাশ শুধু নীল। সাদা বা কালো কোন মেঘ নেই। এমন মেঘহীন আকাশ বাংলাদেশে কল্পনাও করা যায় না। আকাশে চিরকাল আমরা মেঘের আল্পনা দেখেই অভ্যস্ত।

***

এখন মনে নেই; সম্ভবত জেট এয়ারের নিজস্ব মাসিক প্রকাশনা ঝরোকা। হাতে নিলাম, বেশ উন্নত মানের। প্রচ্ছদে তাজমহলের ছবি, ভিতরে আছে, লালকেল্লা, কুতুবমিনার, আরো বহু মোগলস্থাপনা। একটা তথ্য পেলাম বড় চমকপ্রদ! ভারতের পর্যটনমন্ত্রী শ্রী জেসো নায়েক বলেন, ৩৬১ বছরের পুরোনো শ্বেতমর্মর পাথরের তৈরী তাজমহল থেকে ভারতের বার্ষিক  আয় একুশ কোটি চৌরাশি লাখ রুপি, এমনকি হুমায়ূনের সমাধি থেকেও বছরে আসে ৮ কোটি ১২ লাখ রুপি। এভাবে মুসলিম স্থাপনাগুলো থেকে বার্ষিক ৮০ কোটিরও বেশী আয় করে ভারত।

নায়েক সাহেব বড় লায়েক মানুষ। তিনি পরোক্ষ আয়গুলোও ধরতে পারতেন। তাহলে কিন্তু আয়ের অঙ্কটা হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে! শুধু এটা ভাবলেই তো হয়, পর্যটকরা তো আর রাস্তায় থাকে না, দিল্লী ও আগ্রার রমরমা হোটেল-ব্যবসা তো তাদেরই কল্যাণে!

কিন্তু পর্যটনমন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত লিফলেট ও বুকলেটগুলোতে মোগলবিরোধী ও মুসলিমবিরোধী প্রচারণার কমতি নেই। আমার সামনে যে ঝরোকা তাতেও মোগলহেরেমের কাল্পনিক বর্ণনা রয়েছে, যা সত্যি কষ্টদায়ক। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, যে পাতে খাওয়া সেই পাত ফুটো করা, এ যেন তারই বাস্তব নমুনা!

কিছু দিন আগে নয়া দিগন্তের ভেতরের পাতায়ও দেখলাম পরিসংখ্যানটি। পরিসংখ্যান দিয়ে আর কী হবে, সব তো আমাদের ভুলের মাশুল। বিরক্তির সঙ্গে পত্রিকাটা রেখে দিলাম, আবার হাতে নিলাম, তুরস্কের ইতিহাস।

***

পাইলটের পক্ষ হতে ঘোষণা হলো, তাছাড়া নিজেও দূর থেকেই দেখতে পেলাম দিল্লীর জনপদের আভাস। হাঁ, দিল্লী এসে গেছে। মনের মধ্যে আশ্চর্য রকমের এক রোমাঞ্চ অনুভূত হলো। বিমান একটু একটু করে নীচে নেমে আসছে। এখন ১৫ হাজার ফুট। দালানকোঠা, ইমারত দেখা যাচ্ছে, তবে অস্পষ্ট। প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ীগুলো চলছে বেশ সুশৃঙ্খলভাবে, যদিও দেখতে মনে হয় বাচ্চাদের খেলনা গাড়ী। বিমান আরো নেমে এলো। চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো নতুন দিল্লী। পুরান দিল্লীটা কোন্দিকে কে জানে!

আবারও মনটা বিষণ্ণ হলো একথা ভেবে যে, দিল্লীতে নামবো, অথচ দিল্লীর কাছে যেতে পারবো না! একদিন যে দিল্লী আমার ছিলো, এখনো আমারই আছে, সেই দিল্লীতে এসেও দিল্লীকে দেখতে পাবো না! ঐতিহাসিক জামে মসজিদ, লালকেল্লা, কুতুবমিনার, এসবের এত কাছে এসেও কাছে যেতে পারবো না! ভাবতে গিয়ে সত্যি মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। তবে এই ভেবে সান্তবনা পেলাম যে, আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই মানবের জন্য কল্যাণকর।

এবার বিমান এত কাছে নেমে এসেছে যে, মানুষকে মানুষের মত দেখা যাচ্ছে! দাঙ্গার সময় যারা মানুষ খুন করে, মানুষকে পুড়িয়ে মারে তখন কি তাদেরকে মানুষের মত দেখায়? এই বিমানের যাত্রীদের মধ্যে কি এমন হিন্দু নেই যার হাত কখনো না কখনো কোন না কোন মুসলিমের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে? গুজরাটের মুসলিম নিধনযজ্ঞে যারা বীভৎস উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, মুসলিম নেতা সৈয়দ জাফরীকে তাঁর ঘরে যারা পুড়িয়ে মেরেছিলো, যার বিচারের জন্য তার বিধবা স্ত্রী আজো দাঁড়িয়ে আছেন আদালতের দুয়ারে, তাদের কেউ কি আছে এই দুআড়াইশ যাত্রীর মধ্যে? দুসারি পিছনে ঐ যে বিশালদেহী শিখ, মাথায় বিরাট পাগড়ী, যেমন দাড়ি তেমন গোঁফ! সাতচল্লিশে এই দিল্লীতে শিখেরা যখন নারকীয় উল্লাসে মুসলিম রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিলো তখন এই সরদারজীর বয়স কত ছিলো? হয়ত শিশু ছিলো। তখন তার বাপচাচারা কী করেছিলো কে জানে! কত মুসলিম যুবতী শিখদের দ্বারা অপহৃত হয়েছে, মৃত্যু পর্যন্ত যাদের পুরো জীবন কেটেছে শিখপুরুষদের সেবাদাসী হয়ে?

আশ্চর্য, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর এই দিল্লীতেই হিন্দুদের হাতে শিখসম্প্রদায় কচুকাটা হয়েছে, আর মুসলিমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছে তাদের আশ্রয় দিতে। সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় পরিবার থেকে বিচ্যুত বেশকিছু শিশু-নারী, শুনেছি, এখনো কোন কোন মুসলিম পরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছে। কারণ তাদের এখন কোন পরিবারই নেই। মা-বাবা, ভাই-চাচা সবাই দাঙ্গায় নিহত হয়েছে।

***

আমার কী দোষ! নীচু আকাশ থেকে দিল্লীর মানুষগুলোকে মানুষের মত দেখতে পেয়ে মনটা কেমন ভাবালু হয়ে উঠলো, আর এত কথা মনে পড়ে গেলো! জানালাপথে আবার তাকালাম, এবার আস্ত বিমানবন্দরটা চোখের সামনে। না আকাশ দেখতে পাচ্ছি, না ভূমি, না মানুষ। আমাদের দৃষ্টি এমনই সীমাবদ্ধ যে, দূরের আকাশও অনেক সময় হারিয়ে যায় কাছের সামান্য কিছুর আড়ালে। কিংবা অনেক সময় কাছের সামান্য সৌন্দর্য চোখের দৃষ্টি দখল করে নেয় দূরের বিশাল আকাশের অপার সৌন্দর্য থেকে। আমিও তাই আকাশের অপার সৌন্দর্য ভুলে তাকিয়ে থাকলাম চোখের সামনের বিমানবন্দরের সামান্য সৌন্দর্যের দিকে। তখন এত কিছু মনে হয়নি, এখন লেখার সময় কথাটা মনে হয়ে লজ্জার অনুভূতি হলো।

বিমানের চাকা যখন মসৃণ রানওয়ে স্পর্শ করলো, ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার ঘর ছোঁয় ছোঁয়।

আমীর ছাহেব দেখালেন, এই যে এটা হলো প্রথম টার্মিনাল, পরেরটা হলো দ্বিতীয় টার্মিনাল। আগে এদুটোই ছিলো দিল্লী বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন। আর ঐ যে দেখছেন বিশাল ভবন সেটা হলো তৃতীয় টার্মিনাল। আমীর ছাহেব বললেন, আগের বার যখন দিল্লী আসি তখন তৃতীয় টার্মিনাল ভবনটি মাত্র তৈরী হচ্ছে। এখন সব যাত্রী ঐ টার্মিনাল দিয়েই যাতায়াত করে। আমরাও আমাদের অপেক্ষার সময়টুকু ওখানেই অবস্থান করবো।

নাহ, বাইরে থেকেই যদ্দুর বোঝা যাচ্ছে, বিমানবন্দরটা সুন্দর বটে! আগে মনে হয় নাম ছিলো পালাম বিমানবন্দর। ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এর নাম রাখা

হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কখনো কোন কারণেই এ নাম বদলে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। ইন্দিরা গান্ধীর রাজনীতি ও শাসন যারা পছন্দ করতো না, এখনো করে না, তারাও এটা অস্বীকার করে না যে, ভারতের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এটাই ভারতীয় রাজনীতির প্রশংসার দিক। একারণেই এত ভাষা-বর্ণ ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ও রক্তাক্ত ভারত এখনো অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ। অথচ বাংলাদেশ! লোকে বলে, আমরা স্বাধীন হয়েছি এবং স্বাধীনতার বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনো আমরা একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয় অর্জন করতে পারিনি। সমগ্র জাতি মোটা দাগে বাংলাদেশী এবং বাঙ্গালী, এ দুই জাতীয়তায় বিভক্ত হয়ে আছি। আর সুযোগ পেলেই বিমানবন্দর তো বটেই, এমনকি ছোট ছোট পোলেরও নাম পরিবর্তন করে ফেলছি। রাজনীতির কী নোংরা চেহারা! ভারত থেকে তো চাল, ডাল, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে, টাটার গাড়ী পর্যন্ত সবকিছুই আমরা আমদানি করি এবং বিরাট বাণিজ্যঘাটতির বোঝা টানি; তাদের এ ঈর্ষণীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা তো আমরা বিনা পয়সায় আমদানি করতে পারি! আগে আমাদের গরীব দেশে খুব মিসকিন ধরনের একটা বিমানবন্দর ছিলো তেজগাঁয়ে, বিশ্বাসই হতে চায় না, সেটাই ছিলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর! তারপর হলো কুর্মিটোলা বিমান-বন্দর। বানিয়েছিলেন বেচারা আইয়ূব খান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর নাম হলো জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেই নাম পাল্টে এখন হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর! কাজটা ভালো, মতলবটা কেমন? স্বীকার করতেই হয়, এদের ঘটে বুদ্ধি আছে বটে!

***

ব্রিজের মুখে এসে বিমানটা দাঁড়ালো। জেট এয়ারে ভ্রমণ করে আমরা যে তাদের ধন্য করলাম সে জন্য আমাদের বহুত বহুত ধন্য়োবাদ জানানো হলো, আর বলা হলো, ....

উর্দূ ও হিন্দী, বলা হয় আলাদা ভাষা। পার্থক্যটা আসলে কতটুকু! ভাষার মূল বিষয় হলো ব্যাকরণ ও কাঠামো। এক্ষেত্রে উভয় ভাষা এক, সম্পূর্ণ এক। হিন্দিতে সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য রয়েছে। সেটাও প--ত সমাজে সীমাবদ্ধ, যেমন আমাদের বাংলাভাষায় (একসময় ছিলো)। ভিন্নতা যা তা শুধু লেবাসে, অর্থাৎ

বর্ণমালায়। শুধু বর্ণমালাটুকু শিখে নিলে বাংলাভাষী আলেমদের জন্য হিন্দিভাষাটা রপ্ত করা খুবই সহজ, গঙ্গা থেকে একঘটি জল আনার চেয়ে সহজ। প্রতিবেশী একটি বিশাল দেশ, যার জনসংখ্যা শতকোটি অতিক্রম করেছে, সেই বিশাল দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর সরকারী ভাষা হলো হিন্দি। তো আমাদের আলেমসমাজে কিছু লোক থাকা দরকার যারা এভাষায় অন্তত কথা বলতে পারে এবং লেখা পড়তে পারে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু দিন থেকে আমি হিন্দি বর্ণমালা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি। এখন মোটামুটি পড়তে পারি।

বিমানবালা তার পেশাদার হাসিটুকু ফুটিয়ে তুলে মিষ্টি ভাষায় বললো, আশা হ্যয় কি আপ হামেঁ দোবারা সেওয়া কা মওকা দেঙ্গে। ইসসে হামারী আত্মা কো শান্তি মিলেগী।

আহা, ভারত আমাদের কত না ভালোবাসে! কিন্তু একবার যদি ভেবে দেখতো আমাদের আত্মার শান্তির কথা!

আমরা বলি যাত্রা, ওরা বলে ইয়াত্রা, পরীক্ষাকে বলে পরীক্ষা, লক্ষ্মীকে বলে লক্ষমী, আর আত্মাকে বলে, আত্মা। গান্ধীর আত্মা কত বড় ছিলো জানি না, সেটা বলতে পারতো, সাতচলিস্নশের ভয়াবহ দাঙ্গায় যারা নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলো তারা। ভারতীয়রা বলে, মহাত্মা গান্ধী। বিমানে প্রবেশের সময় দেখিনি, বের হওয়ার সময় দেখলাম, দরজার পাশে দেয়ালে মহাত্মাজীর ছবি! অতিভক্ত একজন দুজন দেখলাম যাওয়ার সময় হাতে ব্যাগ থাকা সত্ত্বেও জোড়হাতে প্রণাম করলেন।

***

বিমানের দরজা খোলা হলো। যাত্রীরা বিশেষ তাড়াহুড়া করলো না। মোটামুটি ধীরেসুস্থেই বের হলো। আমরা দরজার কাছাকাছি ছিলাম। তাই পনের বিশজনের পরই বের হওয়ার সুযোগ পেলাম।

টার্মিনালভবনের ভিতরটা দেখে তো অবাক! বিশাল, একমাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না। আমীর ছাহেব বললেন, প্রায় দুকিলোমিটার দীর্ঘ। পুরোটা মেঝে সুদৃশ্য গালিচায় মোড়া। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। একটু পর পর মাঝখান দিয়ে চলন্ত পথ। আপনি ইচ্ছা করলে পাশ দিয়ে হেঁটে যান, আবার ইচ্ছা করলে চলন্ত পথে উঠে দাঁড়িয়ে থাকুন। পথ নিজেই চলতে থাকবে। শেষ মাথায় এসে নেমে পড়ুন, কিছুক্ষণ হাঁটুন, আবার চলন্ত পথে উঠুন। বেশ মজার বিষয়। তবে, অনভ্যস্ততার কারণে সবাই উঠতে চায় না, পাশ দিয়ে হেঁটে যায়।  আমরা চলন্ত পথ ব্যবহার করলাম। তাই দীর্ঘ পথ পার হওয়াটা তত কষ্টকর হলো না। চলন্ত পথটাও দেখার মত সুন্দর। গরীব বাংলাদেশের তো প্রশ্নই আসে না, এমনকি জিদ্দা, কুয়েত ও দুবাই বিমানবন্দরেও এ ব্যবস্থা দেখিনি; ইস্তাম্বুলে অবশ্য দেখেছি, যদিও এতটা সুন্দর নয়। হয়ত নতুন বলে সবকিছু এত ঝকঝকে তকতকে। মানুষ- জন কম, তাই নির্জন নির্জন ভাব। বেশ লাগছে। সবচে ভালো লাগলো যা তা হলো টয়লেটব্যবস্থা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার পথে হাতের ডান পাশে একটু পর পর টয়লেট। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, উপরের লেখাটা না দেখে। একপাশে পুরুষদের, একপাশে মহিলাদের। সম্পূর্ণ পৃথক। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থাও রুচিসম্মত।

টয়লেটের সংখ্যা এত পর্যাপ্ত যে, ভিড় হওয়ার সুযোগ নেই। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে দূরের কথা চিন্তা করে। লজ্জার সঙ্গে বলতে হয়, কুয়েত, দুবাই, আবুধাবী, এমনকি জেদ্দার মালিক আব্দুল আযীয বিমানবন্দর, কোথাও টয়লেটব্যবস্থা এত সুন্দর নয়, এবং এত পর্যাপ্ত নয়। পরিচ্ছন্নতারও অভাব দেখেছি। এমনকি জেদ্দায় পানির সমস্যায় পড়তে হয়েছে একাধিকবার, তাও হজ্ব মওসুমে নয়, রামাযানে।

পুরুষ ও মহিলাদের টয়লেট চেনার উপায় কী? এক্ষেত্রে অবশ্য রুচিহীনতার পরিচয় পাওয়া গেলো। প্রতিটি টয়লেটের প্রবেশপথের একটু ভিতরে কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর বিরাট ছবি রয়েছে। ছবি দেখে বুঝতে হবে, এটা পুরুষ টয়লেট, আর ছবি দেখে বুঝতে হবে, মহিলা টয়লেট। ভাবতে অবাক লাগে, এমনও রুচি হয় কোন দেশের মানুষের! ভাগ্য ভালো যে, নেহরু, বা ইন্দিরা গান্ধীর ছবি ব্যবহার করা হয়নি এ মহৎ উদ্দেশ্যে!

পথ যেন ফুরোতেই চায় না। এক কিলোমিটারের কাছাকাছি হবে, হাঁটা হয়েছে। চলন্ত পথগুলো ছিলো বলে রক্ষা। হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা নির্দেশনা দেখে এগিয়ে চলেছি। আমরা মনে হয় কিছুটা ধীরে হাঁটছি। অন্য যাত্রীরা আমাদের পিছনে ফেলে চলে গিয়েছে। একসময় দেখি, আমরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই। কিছুক্ষণ পর দেখি, অন্য বিমানের যাত্রীরা আসছে। আমরা হয়ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, এছাড়াও ট্রানজিট যাত্রী বলে কোনো তাড়াও ছিল না।

কিছুক্ষণ পর হাতের বামে নীচে নামার সিঁড়ি পাওয়া গেলো, পাশে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। যারা বিমানবন্দরের বাইরে যাবে তারা এ পথে নীচে নেমে গিয়েছে। এটা হলো টার্মিনাল ভবনের মাঝামাঝি স্থান। যারা ট্রানজিট যাত্রী তারা এখানেই অপেক্ষা করে। ব্যবস্থাটাও সুন্দর। ঢেউ খেলানো এ বস্ত্তগুলোকে কী বলবো, আরাম চেয়ার, না চৌকি? চিৎ হয়ে ভাঁজে ভাঁজে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কেউ শুয়ে আছে, কেউ ঘুমিয়ে আছে। এ ব্যবস্থাটাও আগে কোথাও দেখিনি।

***

সামানপত্র রেখে একটু স্থির হয়ে বসেছি কি বসিনি, বিমানবন্দরের চৌকশ একজন অফিসার এসে হাজির। মুখে অমায়িক হাসি। সৌজন্য বিনিময় করলেন, যেন আমরা তারই মেহমান! পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করে পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন যেন আমাদের সাহায্য করার ইচ্ছে!

ভদ্রলোক ইংরেজিতে শুরু করেছিলেন, আমি বললাম, আপ হিন্দি মেঁ ক্যহিয়্যে না, হাম হিন্দি  আচ্ছী ত্যর‌্যহ স্যম্যঝতে হ্যাঁয়, অওর কুছ না কুছ বোল ভি লেতে হ্যাঁয়।

ভদ্রলোক মুখের হাসিটা বিসত্মৃত করে বললেন, ধন্য়োবাদ, ধন্য়োবাদ। এর পর হিন্দিতেই কথা হলো। আসলে তিনি বললেন হিন্দি, আমরা বললাম উর্দূ। একটা দুটো শব্দ ছাড়া ফল দাঁড়ালো অভিন্ন। এ যেন নিয়তের মু্আমালা। হিন্দির নিয়তে বললে হিন্দি, উর্দূর নিয়তে হলে উর্দূ। সমস্যা যা তা হলো লেখা বা পড়ার ক্ষেত্রে।

আমরা তিনজনই খুব প্রীত হলাম যে, কত সৌজন্যবোধ! কী আন্তরিকতা ও সযত্ন আচরণ! ডাল মে যে কুছ কালা আছে তা বুঝতে পেরেছি, অনেক পরে গভীর রাতে।

আসলে আমাদের লেবাসের যে কোন যাত্রী তাদের মনোযোগের কারণ হয়ে থাকে। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বাঙ্গালী দাদাবাবু কোন বার্তা পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য, যার প্রথম দফা এই মাত্র সম্পন্ন হলো এবং আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে।

***

যোহরের নামায পড়ে দস্তরখানের আয়োজন করা হলো। আমার সঙ্গে তো প্রচুর খাবার ছিলোই, মাওলানা আব্দুল মতীন ছাহেবের ঘর থেকেও অনেক খাবার দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত তৃপ্তিসহকারে ঠিক যেন ঘরোয়া দস্তরখানে বসে খাবার খেলাম। ক্ষুধার সময়ের খাদ্য, তাও ঘরে আপনজনের হাতে তৈরী, এ যে আল্লাহর কত বড় নেয়ামত, তা আজকের মত আর কখনো উপলব্ধিতে আসেনি। আমাদের নারীরা আমাদের জন্য কত কষ্ট করে এবং আনন্দের সঙ্গে! এখন হয়ত ওরা ভাবছে, সঙ্গে খাবার তো দিয়েছি, কিন্তু ঠিকমত খেতে পারছে তো? নষ্ট হয়ে যায়নি তো?

এই ভেবে হয়ত ওদের মুখে খাবার রোচবে না, অথচ আমরা তো আনন্দের সঙ্গেই খেলাম। আমাদের প্রতিটি ঘরে আল্লাহ যেন নারীদের উত্তম বিনিময় দান করেন। আমাদের দায়িত্ব ছিলো তাদের দ্বীনী তারবিয়াত করা, তাদের অসম্পূর্ণতাগুলো কোমলভাবে সংশোধন করা, আমরা তা করিনি, করতে পারিনি। সে যোগ্যতাও নেই আমাদের অনেকের। আল্লাহ, তুমি নিজে তাদের তারবিয়াত করো, তাদের এবং আমাদের সমস্ত অসম্পূর্ণতা দূর করে দাও। আমাদের পূর্ণতা ও পরিপূর্ণতা দান করো।

ক্ষুধার কষ্ট থেকে তৃপ্তির সঙ্গে মুক্ত হয়ে দিল থেকেই দুআ করলাম। নিজেদের মধ্যেও এ বিষয়ে খুব দরদের সঙ্গে আলোচনা হলো। মুদীর ছাহেব মৃদু হেসে বললেন, আদীব হুযূর হলেন আসল নারীবাদী, তবে আপনার কিছুটা পুরুষবাদীও হওয়া দরকার। আমি বললাম, আসলে আমি চেষ্টা করছি মানববাদী হওয়ার এবং ভালো সমত্মান, ভালো ভাই, ভালো স্বামী ও ভালো বাবা হওয়ার।

***

দস্তরখানে থাকা অবস্থায় একটি দৃশ্য দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। একটু দূরে একজন কর্তাবাবু চেয়ারে বসে আছেন বেশ হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে। তার পায়ের ধারে খুব জড়সড় হয়ে বসে আছে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। অল্পবয়সের কৃষ্ণবর্ণের মহিলা। এদেরই মনে হয় বলে অচ্ছুত। কী নিয়ে যেন কর্তাবাবু বেশ ধমকাচ্ছেন, আর মহিলাটি জোড়হাতে ক্ষমা চাচ্ছে। কর্তাবাবুটিকে মনে হলো, সারা ভারতের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি, আর জোড়হাত মহিলাটি যেন অবহেলিত, লাঞ্ছিত বঞ্চিত কোটি কোটি নীচ বর্ণের মানুষের প্রতিনিধি। হঠাৎ কর্তাবাবু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন। মহিলাটি মনে হলো এধরনের চড়-থাপ্পড়ে অভ্যস্ত। তাই যেমন বসা ছিলো তেমনি বসে থাকলো। চপেটাঘাতের কারণে মাথাটা শুধু একদিকে কাত হয়ে গেলো। কর্তাবাবুর সম্ভবত হঠাৎ মনে হলো, থাপ্পড় তো দিলেন, কিন্তু হাতটি যে বড় অপবিত্র হয়ে গেলো! তাই প্রথমে নিজের হাতটির দিকে কাতর দৃষ্টিতে দেখলেন, তারপর তাকালেন অচ্ছুত প্রাণীটির দিকে আগুনঝরা দৃষ্টিতে। ভাগ্য ভালো মহিলাটির যে, ধারে কাছে ছড়ি ছিলো না। পুরো দৃশ্যটা দূর থেকে শুধু দেখলাম। নিজের দেশে হলেও তো আমাদের মত নির্বীর্য মানুষের কিছু করার থাকে না, আর এ তো রীতিমত বিদেশ, এবং ইন্ডিয়া। নিজের অজামেত্মই চোখদুটো শুধু ভিজে উঠলো। কী অপরাধ ছিলো মহিলাটির কে জানে! অচ্ছুত হয়ে জন্ম নেয়াটাই তো এক বিরাট অপরাধ!

কিছুক্ষণ পর দেখি কর্তাবাবু উঠে চলে গেলেন, আর মহিলাটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করছে, আমাদের কোন প্রয়োজন আছে কি না! আমরা তিনজনই খুব সম্মানের সঙ্গে তাকে গ্রহণ করলাম এবং খোঁজখবর নিলাম। সম্ভবত এরকম আচরণ, এমনকি বিদেশীদের কাছ থেকেও সে পেয়ে অভ্যস্ত নয়। আমরা তিনজনই তাকে কিছু হাদিয়া দিলাম। মুদীর ছাহেবের কাছে ভারতীয় রূপী ছিলো, আমার কাছে কিছু ডলার ছিলো, সবচে ছোট নোটটি ছিলো পাঁচ ডলারের। সেটাই দিলাম। মহিলা তো অবাক, এতক্ষণ বুকের ভেতর জমে থাকা লাঞ্ছনার সব কষ্ট যেন চোখের পানি হয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর যে কথাটা বললো তা এখনো আমার কানে বাজে, আপ মোহামেডান লোগ বহুত আচ্ছে হোতে হো।

দিল্লীতে কোন এক বসিত্মতে থাকে। মা আছে, আর আছে ছোট দুটি ছেলে মেয়ে।

বললো, বাবুজী, হাম তো ইনসান নেহী, হাম অচ্ছূত হ্যাঁয়।

আপনারা এমন করে আমার খোঁজ নিলেন, আমার বহুত ভালো লাগলো, নিজেকে ইনসান মনে হলো। আমাদের ধর্মের লোকেরাও তো আমাদের ইনসান মনে করে না।

জানতে চাইলো, কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি। কাল এসে আবার দেখতে পাবে কি না?

কয়েক বাটি খাবার ছিলো। একটি বাটিতে মাওলানা আব্দুল মতীন কিছু রুটি আর গোশত দিলেন। খুব খুশী হলো। আমি ব্রিফকেস থেকে বের করে দুপ্যাকেট বিস্কিট দিলাম, আপনে ব্যচ্চোঁ কো মেরী ত্যরফ সে দে না।

আবারও তার চোখ সজল হলো, বললো, আপ লোগ স্যচমুচ বহুত আচ্ছে হো, ভগওয়ান আপ লোগো কা ভালা করে।

এমন কি রাত আটটায় কাজ শেষে বসিত্মতে ফিরে যাওয়ার সময় এসে দেখা করলো। অনেক অনেক শুকরিয়া জানালো।

আমরা বললাম, আল্লাহ চাহে তো চার দিন পর যখন আমরা ফিরবো তখন আবার দেখা হবে।

মুদীর ছাহেব বললেন, ভারতে দাওয়াতের ময়দান খুবই উর্বর। মুসলমানেরা যদি হিন্দুদের সঙ্গে, বিশেষ করে এই দলিত শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে কিছুটা সদয় আচরণ করে তাহলেই দলে দলে মানুষ মুসলমান হতে পারে।

মাওলানা আব্দুল মতীন দুএকজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম নিলেন যারা অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাওয়াতের কাজ করছেন এবং অনেক সুফল পাচ্ছেন।

আমি বললাম, আসলেও এটাই সবচে বড় সত্য যে, আমরা মুসলিমরাই ইসলামী আখলাক হারিয়ে ফেলেছি। আমরাই অমুসলিমদের জন্য ইসলামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমরা যদি ইসলামের সত্যিকার ধারক হতে পারি তাহলে আবার ভারত আমাদের হতে পারে।

***

নিজেকে মনে হচ্ছিলো খাঁচায় বন্দী এক পাখী। দিল্লীতে আছি, কিন্তু দিল্লীর কাছে যাওয়ার

সুযোগ নেই। মনের ভিতরে কী যে তোলপাড় হচ্ছে, ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য নেই। একবার একটি পাখী দেখেছিলাম, খাঁচার ভিতরে ছটফট করছে বের হয়ে আসার জন্য। দৃশ্যটা মনে পড়লেই মনটা কেমন করে ওঠে। কত আগের কথা, কিন্তু স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে, যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। নিজেকে এখন সেই রকম ছটফট করা পাখীটার মতই মনে হলো।

আছরের নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করলাম। মুদীর ছাহেব এবং মাওলানা আব্দুল মতীন কিছু সময় ঘুমিয়েছেন। আরাম চেয়ার, বা চৌকিটা সত্যি বেশ আরামদায়ক, আমি শুধু শুয়ে ছিলাম, ঘুম আসেনি ভিতরের অস্থিরতার কারণে।

আছরের পর। একা একা একটু পায়চারি করলাম। আমরা এসেছিলাম পূর্বদিক থেকে, তাই একটু পশ্চিম দিকে গেলাম। এদিকে হাতের বাম দিকে কাঁচের দেয়াল আছে। বিমানবন্দরের মাঠ এবং দৌড়ক্ষেত্রের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে এবং .. এবং আবার আমার অন্তরে এ বিশ্বাস সুদৃঢ় হলো যে, দয়াময় আল্লাহ বান্দার মনের ইচ্ছেগুলো বড় দয়া, মায়া ও মমতার সঙ্গে পূর্ণ করেন। বিমান তো যথেষ্ট ওঠানামা করছে। তবে একটা বিমান দেখতে পাচ্ছি, যদি আর দুহাত ডান দিকে হতো তাহলে বিমানের সিঁড়িটা দেখতে পেতাম না এবং দেখতে পেতাম না সেই পবিত্র নূরানি দৃশ্য। বিমানটা সম্ভবত আমিরাতের। সিঁড়ি বেয়ে এহরামের সাদা লেবাসে হাজী ছাহেবান আরোহণ করছেন। হয়ত বাসে করে টার্মিনাল ভবন থেকে তাদের আনা হয়েছে। আহ, কী নূরানি দৃশ্য! ঢাকায় তো আল্লাহ হাজী ছাহেবানদের কাতারেও দাঁড় করিয়েছেন। দিল্লীতে দেখালেন হাজী ছাহেবানের বিমানে আরোহণের দৃশ্য! ঠিক এ মুহূর্তে যদি এখানে এসে না দাঁড়াতাম! কে আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছেন? চলেছি তুরস্কের সফরে, কিন্তু দয়াময় বারবার আমাদের দান করছেন হেজাযের ছোঁয়া এবং বাইতুল্লাহর ছায়া! শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!

অন্তরে তখন যে অনুভূতিটা হলো তা যদি ভাষায় প্রকাশ করি তাহলে বলা যায়, আনন্দের কষ্ট এবং কষ্টের আনন্দ। হাঁ, বিমানে হাজী ছাহেবানের আরোহণের দৃশ্য দেখামাত্র আনন্দের অনির্বচনীয় একটি শিহরণ অনুভূত হলো, আবার মুহূর্তের মধ্যে সেটা রূপান্তরিত হলো বেদনার অনুভূতিতে যে, হায়, আমার তো নছীব হলো না এই নূরানি কাফেলায় শামিল হওয়ার! তবে সেই বেদনার মধ্যেও একটা আনন্দের ছায়াপাত ঘটলো যে, এদেশ থেকে, সেদেশ থেকে, প্রতিটি দেশ থেকে যারা বাইতুল্লাহর কাফেলায় রওয়ানা হয়েছে তারা তো আমারই ভাই। মিনায়, আরাফায়, মুযদালিফায় এবং বাইতুল্লায় তারা তো আমাদেরও জন্য দুআ করবে! আল্লাহ, তুমি হাজী ছাহেবানের হজ্ব কবুল করো, তাদের সমস্ত নেক দুআ কবুল করো, আমীন।

***

মাগরিবের সময় হলো। আছরের মত মাগরিবেও আযান দেয়া হলো এবং জামাতের সঙ্গে নামায হলো। কিছুক্ষণ পর আবার গিয়ে দাঁড়ালাম কাঁচের দেয়ালের সামনে, কিন্তু .. বিমানটি আর সেখানে নেই! কখন যেন ডানা মেলে পশ্চিম আকাশে উড়াল দিয়েছে! পশ্চিম আকাশে লাল বাতির কোন চিহ্ন নেই। যাও হে বাইতুল্লাহর মুসাফির!

 আল্লাহর ঘর দেখে চোখ জোড়াও, প্রাণ শীতল করো।

এশার নামায পড়ে আবার দস্তরখান। আশ্চর্য, খাবারগুলো একটুও অন্য রকম হয়নি। শুধু ঠাণ্ডা, কিন্তু একেবারে তাজা! আবারও বলতে হয়, খাবারগুলো যারা মমতার স্পর্শ দিয়ে তৈরী করেছে, এ তারই বরকত। একত্রে তৃপ্তির সঙ্গে আহার করলাম। একই দেশে জীবনের কতগুলো বসন্ত আমরা পার করেছি, কিন্তু একসঙ্গে এমন প্রীতির সঙ্গে এমন তৃপ্তির আহার আর কোনদিন হয়নি, আর কোনদিন কি হবে?

***

দস্তরখান থেকে মাত্র ফারেগ হয়েছি, তৃপ্তিটা তখনো জিহবায় লেগে আছে। তাই বড় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দুআটা পড়া শুরু করেছি, এমন সময় আবার সেই প্রশ্ন! দুপুরের লোকটা নয়, তবে প্রশ্নটা অভিন্ন। এবার আমরা তিনজনই অবাক হলাম। বুঝতে বাকি থাকলো না, এটা আর সৌজন্যের প্রশ্ন নয়, তদন্তের প্রশ্ন! আরে বাপু, এত বিশাল দেশের বিরুদ্ধে আমরা তিন গোবেচারা কী এমন ষড়যন্ত্র করতে পারি! আমীর ছাহেব শান্তভাবেই সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং ভদ্রলোক চলে গেলেন। যাওয়ার আগে পাসপোর্টগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলেন। হাতের যন্ত্রটার সাহায্যে হয়ত উপরের কারো সঙ্গে কথা বললেন, ভাষাটা ইংরেজি নয়, হিন্দিও নয়। হবে হয়ত কোন প্রদেশের ভাষা। ওদের তো যতটা প্রদেশ তার কয়েকগুণ ভাষা ও সম্প্রদায়। আশ্চর্য, তারপরো ওরা ঐক্যটা বজায় রাখতে পারছে কীভাবে! ভদ্রলোক তো চলে গেলেন, কিন্তু আমাদের মুখে চিমত্মার ছায়া পড়লো। সামনে কি কোন বিপদ আসছে?! হে আল্লাহ! আপন কুদরতে তুমি গরীব পরদেশীদের হেফাযত করো। আমরা ছালাতুল হাজাত পড়লাম এবং দুআ ইউনুসের আশ্রয় নিলাম। নিজেদের দেশেও কি আমরা খুব নিরাপদ! কিন্তু এখন মনে হলো, নিজের দেশে সবকিছুর পরও মানুষ কিসের যেন একটা নিরাপত্তা বোধ করে, যারা ভারত সফর করেছেন তাদের মুখে অনেক বার শুনেছি, বাংলাদেশের সীমানায় পা রাখামাত্র মনে হয়, আহ কী শান্তি! আর কোন ভয় নেই, আমি আমার জন্মভূমিতে এসে পড়েছি। এমনকি বিদেশী জামাতের লোকেরাও বলেন, সীমানা পার হলেই দিলটা অনুভব করে, দারুল ইসলামে এসে পড়েছি! এই একটা সময় শুধু মনে হয়, সাতচলিস্নশে তাহলে আমরা ভুল করিনি।

সাড়ে দশটার দিকে আমরা তিনজন পাশাপাশি তিনটি চেয়ারে শোয়ার আয়োজন করছি, এমন সময় আবার নতুন এক বাবু এসে হাজির! একই নাটকের পূনরাভিনয়। তিনিও চলে গেলেন। মুদীর ছাহেব বললেন, আল্লাহর উপর ভরসা করে শুয়ে পড়ি। কিচ্ছু হবে না। আল্লাহই হেফাযত করবেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিলো যে, আমরা ইতমিনানের সঙ্গে শুয়ে পড়লাম এবং সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লাম।

এবার আর মহান ভারতের প্রতাপশালী সরকার আমাকে আটকে রাখতে পারলো না। দিল্লীর জামে মসজিদে গিয়ে নামায পড়লাম। মাশাআল্লাহ কী বিরাট, আর কী শানদার! ছবিতে যেমন দেখেছি তার চে সুন্দর জামাত শুরু হয়ে গেছে, বোধহয় একরাকাত হয়ে গেছে; মুছল্লীরা সিজদায়। আমিও শামিল হলাম জামাতে। দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম সাহেব তেলাওয়াত করলেন বড় মধুর সুরে, দিল যেন গলে যায়!  কোন সূরা, কী আয়াত, মনে নেই। জেগে উঠে শুধু মনে পড়ছে- ولا تحزنوا  তোমরা দুশ্চিন্তা করো না।

মনের মধ্যে আশ্চর্য এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। আমীর ছাহেব এবং মাওলানা আব্দুল মতীন শান্তির ঘুম ঘুমুচ্ছেন। অন্যরা কেউ ঘুমুচ্ছে, কেউ ঝিমুচ্ছে, আর একদুজন আধশোয়া অবস্থায় পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পড়ছে। একটু দূরে পর্যটনজাতীয় বইপত্র এবং বিভিন্ন মানচিত্রের একটা কর্নার আছে। কেউ চাইলে সেখান থেকে নিতে পারে, তবে লেখা আছে, দয়া করে আবার এখানে রেখে দিন। কটা বিমানবন্দরই বা দেখেছি, তবে দিল্লীতেই শুধু এটা নযরে পড়েছে। বিষয়টি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। দাদারা পর্যটকদের মন ভোলাবার কায়দা-কানুন জানে বটে! তাছাড়া বিশাল দেশটায় দেখার জায়গা এবং দেখার জিনিসও তো কম নয়! এমনকি দেখার মানুষও বহু কিসিমের!!

মনটা তখন এমনই প্রশান্ত এবং পরিচ্ছন্ন ছিলো যে, ইচ্ছে হলো, ওযু করে জায়নামাযে দাঁড়াই।

কাঁচের দেয়ালটা যেখানে সেখানেও কিছু যাত্রী শুয়ে আছে। চেয়ার অবশ্য নেই। কার্পেটের উপরই শুয়ে আছে লাগেজটা মাথার নীচে দিয়ে। আরেকটু এগিয়ে গেলাম। একেবারে নির্জন। কিছুক্ষণ পর পর বিমান থেকে নেমে আসা যাত্রীরা শুধু একটু দূর দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আওয়ায নেই। ধারণা হলো, এরা সব আভ্যন্তরীণ বিমানের যাত্রী। বাংলাদেশ থেকে খুব দূরে তো নয়, কিন্তু যথেষ্ট ভিন্নতা আছে। শোরগোলটা যেন আমাদের একচেটিয়া অধিকারে! পোশাকের বিভিন্নতা থেকেই বোঝা যায়, ভাষায় বর্ণে কত বৈচিত্রপূর্ণ দেশটা। মুসলমানদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। শুধু এখানে এই যে আভ্যন্তরীণ যাত্রীদের মিছিল, তা থেকেই পরিষ্কার ধারণা করা যায়, মুসলিম জনসংখ্যার

কথা সরকারী আদমশুমারিতে যা প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশী। ধুতি, আর শাড়ী দেখে হিন্দু বাঙ্গালীদেরও আলাদা চেনা যায়, যেমন চেনা যায় শিখ ও পাঞ্জাবীদের। রবিঠাকুরের কী যেন একটা কবিতা আছে-

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে

দুএকটা পঙক্তি এরকম-

কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে, সমুদ্রে হল সারা/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন/দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

যাত্রীদের এই বৈচিত্রপূর্ণ মিছিল যেন তারই বাস্তব রূপ। তবে কবি বাবু একটু ভুল করেছেন, মুসলিমজাতি কখনো সাগরতীরে এসে একদেহে লীন হয়নি! অনেক হোলি খেলা হয়েছে এবং হচ্ছে মুসলিম রক্তের, তবু তারা তাদের স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখেছে, ইনশাআল্লাহ বজায় রাখবে।

***

জায়নামাযে দাঁড়ালাম। গভীর রাতের নামাযের সঙ্গে এমনিতেই আমার আত্মীয়তা কম, তাও কেরাত পড়ি আসেত্ম আসেত্ম, বরং মনে মনে। কিন্তু আজ মনের কী যে হলো, তেলাওয়াত করলাম সশব্দে। মনে হলো, জায়নামাজে নয়, আমি দাঁড়িয়ে আছি জিহাদের ময়দানে সম্মুখ লড়াইয়ে। নিজের অজামেত্মই মুখে উচ্চারিত হলো জিহাদের আয়াত-

وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ...

এমন জোশ পয়দা হলো যে, আমার মত ভীরুও যেন এখন তীর-তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কাফিরদের উপর। আমি জানি, এটা বুলেট-রাইফেলের যুগ, তবু মনে এলো তীর-তলোয়ারের কথা। জানি এ জোশ অর্থহীন, তবু নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো। জীবনে এমন জিহাদী নামায পড়ার সৌভাগ্য আর কখনো হয়নি। যারা সত্যিকারের মুজাহিদ; জিহাদের ময়দানে নামাযে দাঁড়িয়ে তারা যে কী স্বাদ পায়, কিছুটা যেন আজ আমিও অনুভব করতে পারলাম।

এমন দরদভরা মুনাজাতও খুব কমই নছীব হয়েছে জীবনে। চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রম্ন ঝরছে, আর মনে পড়ছে কাশ্মীরের মজলুম মুসলমানদের কথা, যাদের বুক থেকে ঝরছে শুধু রক্ত; যেখানে এখন শুধু শোনা যায় শিশুদের কান্না, আর আবরুহারা মা-বোনের আর্তনাদ। কাশ্মীর এখান থেকে কত দূর, খুব বেশী দূরে হয়ত নয়, তাই তো আমার কানে যেন বাজলো মজলুমানের কান্না ও আর্তনাদ।

হে আল্লাহ, হিংস্র হায়েনাদের এ দেশে তোমার মজলুম বান্দাদের তুমি রক্ষা করো, সাহায্য করো। সহায়-সম্বলহীন মুজাহিদীনকে তুমি গায়ব থেকে মদদ করো হে আল্লাহ! কাশ্মীরকে তুমি আযাদ করো হে আল্লাহ!

আসলেই আমি বড় বুজদিল! মুনাজাত শেষ করে ভয়ে ভয়ে তাকালাম ডানে, বায়ে এবং পিছনে, (আল্লাহ ছাড়া আর) কেউ শুনতে পায়নি তো!

পিছনের দিকে তাকিয়েই আমার চক্ষু স্থির! এটাকে বোধহয় ওয়ার লেস বলে, হাতে নিয়ে আমারই দিকে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। হাঁ, ভদ্রই বলতে হবে, যেমন পোশাকে, চেহারায় তেমনি কথা-বার্তায়। জানতে চাইলেন আমাদের ফ্লাইট কখন। আশ্চর্য হলাম প্রশ্নের ভিন্নতায়। জানতে চাইলেন এখানে নির্জনে বসে কী করছি? উত্তর দেয়ার আগেই জায়নামাযের দিকে তাকিয়ে নিজেই বললেন, প্রেয়ার কর রাহে থে? বহুত আচ্ছা।

জানতে চাইলেন, আপনার দুই সঙ্গী কোথায়? বেশ তো! মনে মনে বললাম, দেখেই তো এসেছো, খামোখা জিজ্ঞাসা করার অর্থ? মুখে বললাম, ওহাঁ সো রাহে হ্যাঁয়।

বললেন, ঠীক হ্যয়, ঠীক তিন বাজে ডেস্ক নম্বর চার পর অবশ্য় উপস্থিত হোনা প্যড়েগা। নমস্কার।

নমস্কারের বাচ্চা বিদায় তো হলো, কিন্তু দিলটা ধড়ফড় শুরু করলো। এমন করছে কেন ওরা আমাদের সঙ্গে? ট্রা্নজিট যাত্রী তো আরো আছে, তাদের তো কিছুই বলছে না। মতলবটা কি শুধু পেরেশান করা, না আরো কিছু? চার নম্বর ডেস্ক কোথায়? সেখানে কী হতে পারে? আমাদের অপরাধটা কী? শুধু এই টুপি-দাড়ি, আর মাদরাসার লেবাস?

হঠাৎ মনে পড়লো স্বপ্নের কথা, ولاتحزنوا সঙ্গে সঙ্গে মনের সব দুশ্চিমত্মা দূর হয়ে গেলো। এ স্বপ্ন অর্থহীন হতে পারে না। নিশ্চয় দয়াবান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গায়ব থেকে সান্তবনা দিয়েছেন।

জায়নামাজে বসেই কিছুক্ষণ তেলাওয়াত করলাম। চোখে তন্দ্রা এলো। নাহ, এখন আর ঘুমোবো না। উঠে গেলাম, বইপত্রের কর্নারে। দুটো মানচিত্র নিলাম। একটা দিল্লীর, একটা সমগ্র ভারতের। প্রথমে মনে হলো দেখি তো কাশ্মীর এখান থেকে কোন দিকে, কত দূরে? বেশীক্ষণ তালাশ করতে হলো না, পেয়ে গেলাম। এই যে দিল্লী বিমানবন্দরে আমার অবস্থান থেকে উত্তরে, কিছুটা পশ্চিম কোণে কাশ্মীর! এই যে শ্রীনগর, জুম্মু। এই যে, ঝিলাম নদী! দূরত্ব অবশ্য যথেষ্ট, আটশ কিলোমিটারের কিছু বেশী। তবু মনে হল, কত যেন কাছে। আশ্চর্য এক উত্তেজনা অনুভব করলাম মনের ভিতরে। দিলের ডাক শুনতে পেলাম; এত রক্ত যখন ঝরেছে, এত রক্ত যখন ঝরছে, ইনশাআল্লাহ এ মানচিত্রের রঙ অবশ্যই বদলে যাবে একদিন।

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 



[1]  হাসরত, মানে আফসোস;

   হাসরতভরা, আফসোসপূর্ণ

[2]  উভয় স্থানে স-এর উচ্চারণটা হবে س    এর মত।

 

 

advertisement