যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

ভালো-মন্দের চার সাক্ষী

মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

আমাদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, আমাদের উঠা-বসা, চলা-ফেরা সবকিছুর ভালো-মন্দের থাকছে চারটি সাক্ষী। আমরা যেখানেই থাকি; আলোতে বা আঁধারে, জনসমাবেশে বা লোকচক্ষুর অন্তরালে, দিনে কিবা রাতে, সকালে কি সন্ধ্যায়, সব সময়ই আমরা চারটি সাক্ষীর আওতাভুক্ত। কোনো কথা বা কোনো কাজ যত গোপনেই করি না কেন, চারটি সাক্ষী থেকে আমরা তা গোপন করতে পারি না। তারপরও কীভাবে আমরা নাফরমানীর পথে পা বাড়াই!

প্রথম সাক্ষী : যমীন

প্রথম সাক্ষী হল এই যমীন; আমাদের পায়ের নিচের মাটি, পায়ের নিচের আশ্রয়। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা যার উপর অবস্থান করছি, চলা-ফেরা করছি, আহার গ্রহণ করছি, নিদ্রা যাচ্ছি। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করছেন আমাদের রিযিক; হাজার রকমের ফল-ফসল, যা খেয়ে আমরা জীবন ধারণ করছি। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা যার মুখাপেক্ষী। যার গর্ভ হবে আমাদের শেষ ঠিকানা। এই যমীন আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিআমত। কিন্তু...! কিন্তু কখনো আমরা ভুলে যাই এই নিআমতের কথা, এই নিআমতের যিনি মালিক তাঁর কথা। আমরা লিপ্ত হয়ে পড়ি নাফরমানিতে, এই যমীনের পৃষ্ঠে, যমীনের রবের নাফরমানিতে। যমীনের সহ্য হয় না। কিন্তু তার রবের হুকুমে নীরবে সে বহন করে চলে আমার মত পাপীকে। আমাকে সে গিলে ফেলে না। আল্লাহ নাফরমান বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন, (তরজমা) ‘‘ তোমরা কি আসমানওয়ালার থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছ যে, তিনি তোমাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দেবেন না, যখন তা হঠাৎ থরথর কাঁপতে থাকবে?

-সূরা মুল্ক ৬৭:১৬ (যেমন তিনি কারূনকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি আমাদেরকেও ধ্বসিয়ে দিতে পারেন।)

পানাহ আল্লা! পাপে লিপ্ত অবস্থায় যদি যমীন গিলে ফেলে আমাকে। বা মালাকুল মওত যদি হাযির হয় জান কবজ করতে! কী অবস্থা হবে তখন আমার! হে আল্লাহ, নিজের উপর অনেক যুলুম করেছি। মাফ কর সকল গুনাহ নিজ অনুগ্রহে। তুমি ছাড়া গুনাহ ক্ষমা করার তো আর কেউ নেই। হেফাযত কর সব ধরনের নাফরমানি থেকে। (বান্দা যখন বলে, ‘তুমি ছাড়া গুনাহ ক্ষমা করার তো আর কেউ নেই’ তখন আল্লাহ খুশি হন, মাফ করে দেন।)

হাঁ, কোনো মানুষ জানে না আমার পাপের কথা। যমীন গিলে ফেলে না আমাকে। তবে...! তবে সে সাক্ষী হয়ে থাকে আমার নাফরমানির। তার সাক্ষী হওয়ার ব্যাপারে আমি উদাসীন, কিন্তু সে উদাসীন নয়। সে সব বলে দিবে, তার রব যেদিন তাকে বলার অনুমতি দিবেন। হে আমার রব, আমি সাক্ষী। তোমার এই বান্দা তোমার হাজারো নিআমত ভোগ করে, আমার পৃষ্ঠে অবস্থান করে, অমুক পাপ করেছিল, অমুক দিন করেছিল, অমুক সময় করেছিল। আমি তার সাক্ষী হে আল্লাহ! 

যমীনের এই সাক্ষী হওয়ার বর্ণনা আলকুরআনুল কারীমে ও হাদীস শরীফে এভাবে এসেছে -

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন,

" يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا "

(তরজমা) সেদিন যমীন তার যাবতীয় সংবাদ জানিয়ে দেবে। (সূরা যিলযাল ৯৯ : ৪) তারপর বললেন, তোমরা কি জানো, ‘যমীনের সংবাদ’ কী? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।  তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তার সংবাদ’ হল, প্রতিটি বান্দা-বান্দি যমীনে যা করেছে সে তার সাক্ষী দিবে; অমুক বান্দা অমুক অমুক কাজ করেছে, অমুক দিনে করেছে। এটাই হল, ‘তার সংবাদ’। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪২৯

তেমনিভাবে এই যমীন আমার সকল ভাল কাজের সাক্ষী হবে। আমি যদি এই যমীনে আল্লাহর ঘর নির্মাণের জন্য এক টুকরো যমীন খরিদ করি তা কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সাক্ষী দেবে। আমার জন্য জান্নাতের বালাখানার সাক্ষী হবে। তেমনি যমীনের যে অংশে যে ভাল কাজ আমি করব, তা আল্লাহর দরবারে আমার ঐ ভাল কাজের সাক্ষী হবে। দিন তারিখসহ সে সাক্ষী দেবে; হে আল্লাহ তোমার অমুক বান্দা, অমুক দিন, অমুক সময় এই ভাল কাজ করেছিল, আমি তার সাক্ষাৎ-সাক্ষী।

দ্বিতীয়  সাক্ষী : ফিরিশতা (ও তাদের লিপিবদ্ধ আমলনামা)

দ্বিতীয় সাক্ষী হল ফিরিশতা। আমাদের অমলনামা লিপিবদ্ধের কাজে নিয়োজিত ফিরিশতা । আমরা যা ভাল কাজ করি তাঁরা তা লিপিবদ্ধ করেন। আমরা যা মন্দ কাজ করি তাঁরা তাও লিপিবদ্ধ করেন। তাঁরা তৈরি করেন এমন এক আমলনামা যা কোনো ছোট আমলও ছাড়ে না, কোনো বড় আমলও বাদ দেয় না। যে আমলনামা কিয়ামতের দিন আমাদের সামনে মেলে ধরা হবে। আমরা সেদিন স্বচক্ষে তা দেখতে পাব।

তাঁরা সম্মানিত ফিরিশতা, তাঁরা আমাদের অমলনামা লিপিবদ্ধ করছেন। সকালে সন্ধ্যায়, দিনে রাতে, সদা সর্বদা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ، كِرَامًا كَاتِبِينَ، يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ، إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ، وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ.

(তরজমা) অবশ্যই তোমাদের জন্য কিছু তত্বাবধায়ক (ফিরিশতা) নিযুক্ত আছে। সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ। তোমরা যা কর তারা সব জানে। পূণ্যবানগণ তো থাকবে পরম স্বচ্ছনেদ্য; এবং পাপাচারীরা তো থাকবে জাহান্নামে।

-সূরা ইনফিতার ৮২: ১০-১৪

আমরা যা প্রকাশ্যে করি যা গোপনে করি, দিনের আলোয় করি বা রাতের অন্ধকারে করি, সব আল্লাহ জানেন। সাথে সাথে তাঁর ফিরিশতাগণও তা লিপিবদ্ধ করছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

أَمْ يَحْسَبُونَ أَنَّا لَا نَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَاهُمْ بَلَى وَرُسُلُنَا لَدَيْهِمْ يَكْتُبُونَ

‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন কথাবার্তা ও তাদের কানাকানি শুনতে পায় না? অবশ্যই শুনতে পাই। তাছাড়া আমার ফিরিশতাগণ তাদের কাছেই রয়েছে। তারা (সবকিছু) লিপিবদ্ধ করছে।’ -সূরা যুখরু : ৪৩  ৮০

আমি যতদিন বেঁচে থাকব, যত আমল করব, সব ফিরিশতারা লিপিবদ্ধ করতে থাকবেন। যেদিন আমি ইন্তেকাল করব সেদিন তাদের এই আমলনামা লেখা শেষ হবে। তবে হাঁ, আমার কিছু আমলের সাওয়াব চলতে থাকবে এবং এই আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। নেক আমল বা বদ আমল। ‘সাওয়াবে জারিয়া’ বা ‘গুনাহে জারিয়া’।

আমি যদি এমন কোনো ভাল আমল করি যার ফলাফল চলমান, তাহলে যতদিন তা চলতে থাকবে আমার আমল করার শক্তি ও সুযোগ ফুরিয়ে যাবার পরও ঐ আমলের সাওয়াব যুক্ত হতে থাকবে আমার আমলনামায়। যে ফলাফল দেখে আমি কিয়ামতের দিন বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলব, এত আমল আমি কবে করলাম? আমার আমলনামার ভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ হল কী করে? হাঁ, এমনই হবে আমার আমলনামা যদি রেখে যাই কোনো নেক সন্তান বা নেক আলেম সন্তান। সে যত ভাল কাজ করবে তার সাওয়াবের ভাগ যুক্ত হবে আমার আমলনমায়।

কিন্তু...! কিন্তু আমি যদি এমন কোনো বদ আমল করি যার পাপ চলমান। তাহলে আমার আর রক্ষা নেই। আমার মত হতভাগা আর কেউ নেই। সুতরাং এখন থেকেই সাবধান! খুবই সাবধান!! আমি নিজেকে মুক্ত করব, এখনই মুক্ত করব; যদি আমি এমন কোনো কাজ করে থাকি। আমার সন্তানকে যদি আমি নাচ-গান শিখিয়ে থাকি যার কারণে তার গুনাহ হবে এবং যত মানুষ তার নাচ-গান দেখবে সব গুনাহ তার হবে এবং আমি বেঁচে থাকতে তো অবশ্যই, মরে যাওয়ার পরও আমার এ গুনাহে জারিয়া আমার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে (নাউযুবিল্লাহ্, তোমার পানাহ হে আল্লাহ!)। তা আমাকে ভোগাবে কবরে, হাশরে, মিযানে, পুলসিরাতে। এভাবে চলমান গুনাহের যত পথ আছে আমি যদি তার কোনোটা অবলম্বন করি, তা আমার গুনাহের বোঝাকে করবে বিশাল, আরো বিশাল। কোন্ নির্বোধ আছে যে এপথ অবলম্বন করবে। আল্লাহ হেফাযত করুন।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا

অর্থ: যে ব্যক্তি হেদায়েতের দিকে আহবান করবে, তার আহবানে যারা হেদায়েতের অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি অনুসরণকারীদের সমান প্রতিদান পাবে এবং তা তাদের প্রতিদানে সামান্যও  হ্রাস ঘটাবে না। আনুরূপ যে ব্যাক্তি কোনো গোমরাহীর দিকে আহবান করবে, তার আহবানে যারা গোমরাহীর অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তিরও অনুসরণকারীদের সমান পাপ হবে এবং তা তাদের পাপের মাঝে সামান্যও  হ্রাস ঘটাবে না।

- সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৭৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৯; সুনানে ইবনে মাজাহ্, হাদীস ২০৬

এভাবে পাপের বোঝা ভারি হবে বা পুণ্যের। তারপর কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমার আমলনামা বের করে দিয়ে দিবেন আমার হতে। ইরশাদ হচ্ছে,

وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا

(তরজমা)  ‘‘আর কিয়ামতের দিন আমি (তার আমলনামা) লিপিবদ্ধরূপে তার সামনে বের করে দেব, যা সে উন্মুক্ত পাবে।’’-সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: ১৩

সে এক আশ্চর্য মুহূর্তে। হাশরের ময়দানে বান্দা নগ্নপায়ে, নগ্নবদনে রাববুল আলামীনের সামনে দাঁড়ানো। নিজের আমলনামা নিজের হাতেই উপস্থিত। তাতে দেখা যাচ্ছে নিজের সব নেক আমল ও বদ আমল। সেদিন কী অবস্থা হবে আমার, যদি আমি দেখি আমার অমলনামায় নেকির চেয়ে বদী বেশি। কী জবাব দিব রাববুল আলামীনের সামনে?

বিষয় কি এখানেই শেষ, বরং আল্লাহ আমাকেই পড়তে বলবেন আমার আমলনামা।

اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا

‘‘(বলা হবে) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেয়ার জন্য যথেষ্ট।’’ -সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: ১৪

কারণ সে আমলনামা হবে এক আশ্চর্য আমলনামা। আমলের ছোট বড় কিছুই ছাড়বে না, সব যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে সেখানে। তা দেখে মানুষ সেদিন বলবে, (তরজমা)  ‘...এটা কেমন কিতাব (আমলনামা) তা তো ছোট বড় কিছুই বাদ দেয় না; বরং সবই পঙ্খানুপুঙ্খু হিসাব রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি যুলুম করেন না। - সূরা কাহ্ফ ১৮: ৪৯

সেদিন আমলনামা দেখে কাফের আফসোস করে বলবে- (তরজমা) সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং কাফের বলবে, হায়, আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।’ -সূরা নাবা ৭৮: ৪০

আমলনামা হাতে পেয়ে কেউ থাকবে মহানন্দে, আবার কারো আক্ষেপের সীমা থাকবে না। আলকুরআনুল কারিমে বড় আবেদনময় ভাষায় চিত্রায়িত করা হয়েছে সে সময়ের অবস্থাটির। তারপরও কি আমি সতর্ক হব না?! ইরশাদ হচ্ছে-

(তরজমা) ‘অতপর যাকে আমলনামা দেওয়া হবে ডান হাতে, সে বলবে, এই যে আমার আমলনামা, তোমরা পড়ে দেখ। আমি আগেই বিশ্বাস করেছিলাম, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং সে থাকবে সুখময় জীবনে। সেই সুউচ্চ জান্নাতে- যার ফল থাকবে ঝুঁকে (হাতের নাগালের মধ্যে)। (বলা হবে) তোমরা বিগত জীবনে যেসব কাজ করেছিলে, তার বিনিময়ে খাও ও পান কর স্বাচ্ছন্দ্যে।

আর যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে; তো সে বলবে, আহা! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হত! আর আমি জানতেই না পারতাম, আমার হিসাব কী? আহা! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত! আমার অর্থ-সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না! আমার থেকে আমার সব ক্ষমতাও লুপ্ত হয়ে গেল! (এরূপ ব্যক্তি সম্পর্কে হুকুম দেয়া হবে) ধর ওকে এবং ওর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। তারপর ওকে নিক্ষেপ কর জাহান্নামে।’ -সূরা আল-হাক্কাহ্ ৬৯:১৯-৩১

তৃতীয় সাক্ষী : অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ

তৃতীয় সাক্ষী হল আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমার হাত, যা দ্বারা আমি ধরি। আমার এই পা, যা দ্বারা আমি চলি। আমার চোখ, যা দ্বারা আমি দেখি। কান, যা দ্বার আমি শুনি। এমনিভাবে আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। যা আমার উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত অসংখ্য নিআমতের অন্যতম। এসকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার কাছে আল্লাহর আমানত। আমাকে এই আমানতের হেফাযত করতে হবে এবং এর খেয়ানতের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

আল্লাহ তো দুনিয়াতে বান্দাকে সুযোগ দিয়েছেন। দিয়েছেন নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইচ্ছামতো পরিচালনার স্বাধীনতা ও শক্তি। সাথে সাথে বান্দাকে সতর্কও করেছেন, (তরজমা) ‘আমি ইচ্ছা করলে অবশ্যই তাদের চক্ষুগুলো লোপ করে দিতাম, তখন তারা পথ চলতে চাইলে কীভাবে দেখতে পেত? এবং আমি ইচ্ছা করলে অবশ্যই স্ব স্ব স্থানে তাদের আকৃতি পরিবর্তন করে দিতাম, ফলে তারা (সামনেও) চলতে পারত না এবং (পিছেও) ফিরে আসতে পারত না।’-সূরা ইয়াসীন ৩৬ : ৬৬-৬৭

কত মানুষের হাত আছে তো পা নেই। আবার কারো পা আছে তো হাত নেই। কারো আবার সব আছে কিন্তু চোখ নেই। আবার কারো হাত পা সবই আছে কিন্তু প্যারালাইসিস হয়ে সবই বিকল; সব থেকেও যেন কিছুই নেই। আমাকে আল্লাহ সব দিয়েছেন। তোমার শোকর হে আল্লাহ!

আমাকে এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে, এই আমানতের হেফাযত করতে হবে। আল্লাহর দেয়া নিআমতকে তাঁর হুকুম অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। তাতেই হবে নিআমতের শুকরিয়া, আমানতের হেফাযত।

আমার এ চোখ দিয়ে আমি এমন কিছু দেখব না, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। হাত দিয়ে এমন কিছু ধরব না, যা ধরতে তিনি নিষেধ করেছেন। এমন পথে পা বাড়াবো না, যে পথ শয়তানের। আমার যবান দিয়ে এমন কথা বলব না, যা আমাকে জাহান্নামে নিয়ে ফেলে। মোটকথা, আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে ভাল কাজ করব, খারাপ থেকে বিরত থাকব। কারণ আমার এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাল সাক্ষী হবে। ভাল কাজ করলে আমার পক্ষে সাক্ষী দিবে। মন্দ কাজ করলে আমারই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার বিপক্ষে সাক্ষী দিবে।

সে এক কঠিন পরিস্থিতি! বান্দা আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান। হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। একমাত্র চেষ্টা, কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে। বান্দা চেষ্টা করবে পাপ অস্বীকার করতে। এমনই সময় আল্লাহ অনুমতি দিবেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সাক্ষী দেয়ার। আল্লাহ সেগুলোকে কথা বলার শক্তি দিবেন। সেগুলো কথা বলবে। আমাদেরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমাদের সব গোপন বিষয় বলে দিবে। সব সত্য সত্য বলে দিবে। আমরা অস্বীকার করতে পারব না। আল্লাহ আমাদের যবানে মোহর মেরে দিবেন। আমরা কিছু বলতে পারব না, অস্বীকারও করতে পারব না; কথা বলবে শুধু আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-

الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দিব। ফলে তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।’-সূরা ইয়াসীন ৩৬: ৬৫

শুধু কি তাই! আমার শরীরের চামড়াও সাক্ষী দিবে আমার বিরুদ্ধে, যদি আমি তা আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করি। যে চামড়া আমার চেহারাকে সুন্দর করেছে তা যদি আমি আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যাবহার করি, হারাম ক্ষেত্রে রূপের প্রদর্শন করি, তাহলে তা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। সে বলবে, দুনিয়াতে তুমি আমাকে আমার রবের নাফরমানিতে ব্যবহার করেছ। সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি। আজ আমার রব আমাকে বলার শক্তি দিয়েছেন। আমি আজ সব বলে দিব। 

حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

(তরজমা) অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের চামড়া তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। -সূরা হা-মীম আসসাজদাহ্ ৪১: ২০

তখন মানুষ নিজের শরীরের চামড়াকে বলবে,

وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا

‘তারা তাদের চামড়াকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরম্নদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন?’  সেগুলো  উত্তর দিবে-

أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ

‘আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে।’ -সূরা হা-মীম আসসাজদাহ্ ৪১: ২১

হাঁ, এখনই আমাকে ভাবতে হবে; আমার অবস্থা কেমন হবে। আল্লাহর দেয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কি আমি আল্লাহর আনুগত্যে ব্যবহার করছি না তাঁর নাফরমানিতে। তা কি কিয়ামতের ঐ কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর সামনে, সকল সৃষ্টিজীবের সামনে আমার পক্ষে সাক্ষী দিবে না বিপক্ষে!

চতুর্থ সাক্ষী : আল্লাহ

চতুর্থ সাক্ষী আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ্ই হলেন সবচেয়ে বড় সাক্ষী, প্রথম ও শেষ সাক্ষী, যদিও এখানে চতুর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি হলেন সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী, যিনি অন্তরের কথাও জানেন। যাঁর থেকে গোপন থাকে না আসমান যমীনের কোনোকিছু। যিনি ‘‘আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাহ্’’; যাঁর কাছে দৃশ্য অদৃশ্য সবই সমান।

ইরশাদ হচ্ছে-

أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ

‘এটা কি তোমার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত?’ -সূরা হা-মীম আসসাজদাহ ৪১: ৫৩

তিনি আমাকে দেখছেন, আমি যে অবস্থায়ই থাকি, যেখানেই থাকি। তাঁর কাছে আসমান যমীনের কোনো কিছুই গোপন নয়।

إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

‘নিশ্চিত জেনে রাখ, আল্লাহর কাছে আসমান যমীনের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।’ -সূরা আলে ইমরান ৩: ৫

আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও ত্রুটি হল, আল্লামুরাকাবার বিষয়ে উদাসীনতা; ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এই অনুভূতি দুর্বল হওয়া। ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এই অনুভূতি সদা জাগরুক রাখা চাই। এই অনুভূতি যত প্রবল হবে গুনাহ থেকে বাঁচা তত সহজ হবে। বান্দা যতই গোপন অবস্থায় থাকুক, মানুষের দৃষ্টি থেকে যতই আড়ালে থাকুক, তার যদি এই অনুভূতি থাকে যে, ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ তাহলে গুনাহ থেকে বাঁচা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কিন্তু বান্দা এ বিষয়েই থাকে উদাসীন। ফলে ডুবে থাকে পাপের সাগরে। আল্লাহ বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন-

أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى

‘সে কি জানে না যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন’। -সূরা আলাক ৯৬: ১৪

আমাদের কেউ যদি বুঝে যে, অমুক আমার গুনাহের কথা জেনে গেছে বা আমাকে গুনাহের কাজে দেখে ফেলেছে, তাহলে তার লজ্জার আর শেষ থাকে না। লজ্জা করা উচিত তো আল্লাহকে! সুতরাং হে বান্দা! আল্লাহর বিষয়ে সবচেয়ে উদাসীন থেকো না। স্মরণ কর, আল্লাএই গুণবাচক নামগুলো। তিনি ‘আলীম’ সর্বজ্ঞ; যিনি অন্তরের কল্পনাও জানেন। তিনি ‘সামী’ সর্বশ্রোতা; যিনি পিঁপড়ার পদধ্বনিও শুনতে পান। তিনি ‘বাসীর’ সর্বদ্রষ্টা। তিনি ‘খাবীর’ যিনি সবকিছুর খবর রাখেন। তিনি ‘মুহীত’ সবকিছু তাঁর আয়ত্বাধীন, কোনো কিছু তাঁর পরিধির বাইরে নয়। আর এসবকিছুই বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহ আমাকে সর্বদা দেখছেন।

সুতরাং স্মরণ রাখি, আল্লাহ আমাকে দেখছেন। হারাম বস্তুর দিকে তাকিয়ে সুখ অনুভব করছি? একটু ভাবি, যিনি আমাকে এই চোখ দান করেছেন, যিনি আমার কাছে এই চোখ আমানত হিসেবে দিয়েছেন, তিনি কি আমাকে দেখছেন না? নির্জনে কোনো বেগানা নারীর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছি, অথবা মিছে সুখের ফাঁদে ফোনে কাটিয়ে দিচ্ছি সারারাত। একটু স্মরণ করি, কেউ দেখছে না, আল্লাহ্ও কি দেখছেন না?

সুতরাং হে বন্ধু! কোনো পাপের পথে পা বাড়াবার আগে একটু ভাবি, আল্লাহ আমাকে দেখছেন।

মুমিন গুনাহ করতেই থাকে না; তওবা করে

মুমিন অনবরত বেপরোয়াভাবে গুনাহ করতেই থাকে না। বরং সে তার গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়, আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে। আল্লাহ মুমিনের এ গুণের কথা কুরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে-

وَالَّذِينَ إِذا فَعَلُوا فاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ، أُولئِكَ جَزاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهارُ خالِدِينَ فِيها وَنِعْمَ أَجْرُ الْعامِلِينَ.

‘এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনওভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে- আর আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা যা করে ফেলে, জেনে বুঝে তাতে অটল থাকে না এরাই সেই লোক, যাদের পুরস্কার হচ্ছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত এবং ঐ জান্নাত যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যাতে তারা স্থায়ী জীবন লাভ করবে। আর সৎকর্মশীলদের জন্য কতই না উত্তম প্রতিদান।’ -সূরা আলে ইমরান ৩: ১৩৫-১৩৬

আল্লাহ ক্ষমা করতেই ভালবাসেন

আল্লাহ বান্দাকে বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছেন। আশা ও আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। বান্দা গুনাহগার কিন্তু আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। তাঁর দয়া অসীম, তাঁর ক্ষমা অতি ব্যাপক। সুতরাং হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।

قُلْ يَا عِبادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

‘বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর সীমালংঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করেন। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল বড় মেহেরবান।’ -সূরা যুমার ৩৯: ৫৩

আল্লাহ ক্ষমা করতে ভালবাসেন। তিনি ক্ষমাশীল সুতরাং আমরা তাঁর ক্ষমারই আশা রাখব এবং গুনাহ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করব ও ক্ষমা চাইতে থাকব। হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-

قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বনী আদম! তুমি যত গুনাহই কর, যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে (ক্ষমার) আশা রাখবে আমি তোমার পূর্বের সব (গুনাহ) মাফ করে দিব, কোনো পরোয়া করব না।  হে বনী আদম! তোমার গুনাহ যদি (এত বেশি হয় যে তা) আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দিব, কোনো পরোয়া করব না। হে বনী আদম! যদি তুমি শিরিক থেকে বেঁচে থাক, আর পৃথিবী-ভরা গুনাহও নিয়ে আস তাহলে আমি ঐ পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০

 

 

advertisement