যিলক্বদ ১৪৩৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৪

মানবতার জীবন্ত ছবি

মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রাহ.

 

 [মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রাহ. (১৪১৭ হি.)। ভারতের অধিবাসী উপমহাদেশখ্যাত প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন। পন্ডিত, লেখক-সম্পাদক, গবেষক এবং দাঈ। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের সময় এবং তার কিছুকালের আগের পরিস্থিতি নিয়ে বক্ষ্যমাণ লেখাটি তিনি লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৪০/৪২ বছর আগে। তৎকালীন ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিবেশের মাঝেও কিছু মানবিক ও সম্প্রীতিপূর্ণ ঘটনার অভিজ্ঞতা ও প্রেরণা লেখাটিতে ফুটে ওঠেছে। সেই লেখাটির অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হল।

-সম্পাদক]

[মনযূর নোমানী রাহ.-এর এই ঈমানদীপ্ত লেখাগুলোর অনুবাদ করেছিল আমার শাগরেদ মওলবী হুজ্জাতুলস্নাহ। পরবর্তীতে আমার শাগরেদের শাগরেদ মহিউদ্দিন মুনশীও এর অনুবাদ করে। মওলবী হুজ্জাতুলস্নাহ অনুবাদের কথা ওর জানা ছিল না। উভয়ের অনুবাদের কথা জানতে পেরে আমি প্রথম অনুবাদ আল কাউসারে ছাপার জন্য পেশ করি। কারণ তা আগে হয়েছিল। তাছাড়া দ্বিতীয় অনুবাদের কথা জানতে পেরে প্রথমজন তার অনুবাদ ছাপতে চাইছিল না। এ ছিল ইছারের (অপরকে প্রাধান্য দেওয়ার) এক সুন্দর নমুনা। যার কদর হওয়া উচিত। যাই হোক, সওয়াব তো দুজনই পেয়ে গেছে। আলস্নাহ তাআলা দুজনকেই জাযায়ে খায়ের দিন। ইলমে নাফে দান করম্নন। ইখলাস ও ইতকানের সাথে বেশি বেশি দ্বীনের খেদমত করার তাওফীক নসীব করম্নন

-মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]

 

এক. ভুলতে পারি না

৪২-৪৩ বছর আগের কথা। সম্ভবত ১৯২৮ সাল। আমি তখন আমরম্নহাতে অধ্যাপনা করি। একটি জরম্নরি কাজে দেওবন্দ যেতে হয়েছিল। তখন ছিল শীতকাল। খুব ঠান্ডা পড়েছিল। সেদিন বিকালের ট্রেনেই ফিরে আসার কথা ছিল আমার। তাই রাতে থাকার মতো গরম কাপড়-বিছানা বা কম্বল কিছুই সঙ্গে নেইনি। কাজ সেরে আমি গাজীয়াবাদের ট্রেনে উঠি। গাজীয়াবাদ থেকে আমরম্নহাগামী ট্রেন ছাড়ে। কিন্তু একটি সমস্যা হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সেদিন গাজীয়াবাদের ট্রেনটি এসেছিল একটু দেরিতে। সন্ধ্যায় আমি গাজীয়াবাদ পৌঁছে জানতে পারলাম আমরম্নহাগামী ট্রেন চলে গেছে! পরের ট্রেন রাত এগারোটায়।

এগারোটা বাজতে অনেক দেরি, কী করি? পস্নাটফর্মের একটি বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর এশার নামায পড়ে ঐ বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ঘুমানোর ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কখন যে চোখ লেগে এল। ...হঠাৎ কারো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখি স্টেশনের এক কর্মচারি আমাকে জিজ্ঞাসা  করছে, কোথায় যাবেন মিয়াসাব?  বললাম, আমরম্নহা যাব। ওহ্হো! এই মাত্রই তো আমরম্নহার ট্রেন চলে গেল, পরবর্তী ট্রেন সকালে। আপনি এক কাজ করম্নন, স্টেশনের  মুসাফিরখানায়  চলে  যান।  

আমি মুসাফিরখানায় চলে এলাম। রাত বাজে তখন এগারোটা। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই খুব ঠান্ডা লাগছিল। এদিকে এখনো অনেক  রাত বাকি। সেখানে একটি বেঞ্চ দেখতে পেলাম। সেটাতে গিয়ে কখনো বসছিলাম। আবার বেশি ঠান্ডা লাগলে উঠে পায়চারি করছিলাম। সে-সময় গাজীয়াবাদ স্টেশনে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না।[1] দোকানদারও দোকান বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল। আমি কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে তাকে খোশামোদ করে জাগিয়ে চা খাচ্ছিলাম।             

ঠান্ডার এই কষ্ট ছাড়াও একটি মানসিক কষ্ট হচ্ছিল। আমার সাথে সফরের কোনো সামান  না থাকায় মুসাফিরখানার অন্যান্য যাত্রীরা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। নিজেদের মালসামানের চিন্তায় তারা ঘুমাতে পারছিল না। কিছু বলে যে তাদের আশ্বস্ত করব-তাও পারছিলাম না। মনে পড়ে, খুব বিব্রত হয়েছিলাম ব্যাপারটাতে। লজ্জায়  মাটিতে  মিশে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। একদিকে ঠান্ডা অন্যদিকে এই মানসিক চাপ-কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থায়ই রাত কাটছিল। কখনো  বেঞ্চিতে গিয়ে বসছিলাম। কখনো পায়চারি করছিলাম। কখনো দোকানে গিয়ে চা খাচ্ছিলাম। এমনি করেই রাত আড়াইটা বাজল।

একটু পর সম্ভবত  দেরাদুন থেকে একটি ট্রেন এল। ট্রেন থেকে দুতিনজন যাত্রী মুসাফিরখানায় এসেছিল। তারা বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি শিখ কিশোর ছিল। বয়স পনেরো-ষোলো হবে। মনে হচ্ছিল বিত্তবান ঘরের ছেলে। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আসার কারণে ওর বিছানাটা ছিল বেশ বড়। বিছানা খুলে ছেলেটি তাতে বসল। আমি তখন বেঞ্চে বসে ছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে দুধ পাওয়া যাবে কোথাও?  বললাম, এই সামনে একটি চায়ের দোকান আছে, তাতে পাবে। আপনি একটু আমার বিছানাটা দেখুন, আমি দুধ নিয়ে আসি, আমি রাতের খাবার খাইনি। ছেলেটি দুধ নিয়ে এল। ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও সাধল। আমি না করে দিলাম।  দুধ খেয়ে ও শুয়ে পড়ল। আমি খেয়াল করলাম, এ বেচারাও আড়চোখে বারবার আমাকে দেখছে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল; এ-ও আমার কারণে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে না।  

কয়েক মিনিট পর ও উঠে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই ঠান্ডার মাঝে আপনি এখানে এভাবে কেন বসে আছেন, কম্বল বা চাদর-টাদর কিছু নেই আপনার কাছে? বাবা, তুমি আরাম করো। আসলে রাত নয়টার আগেই আমার আমরম্নহা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল, তাই সঙ্গে কিছু আনিনি। ঘটনাক্রমে ট্রেন ছুটে গেছে, সকাল  ছাড়া আর কোনো ট্রেন নেই। এ কথা শুনে ও তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর বিছানা থেকে দুটো কম্বল বের করল। একটি কম্বল বিছাল, আরেকটি গায়ে দেওয়ার জন্য রেখে আমাকে বলল, আমি এখানে শুয়ে পড়ছি, আপনি আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি সঙ্কোচে  না করলাম। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, শুতেই হবে। আমি বললাম, আচ্ছা, তাহলে অন্তত তুমি তোমার বিছানায় শোও, আমি এখানে শুচ্ছি। না, না, আপনাকে আমার বিছানায়ই শুতে হবে। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল। আমার সঙ্কোচ দেখে ও বলল, আপনি যদি আমার বিছানায় না শোন তাহলে আমি সকাল পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। অগত্যা আমি ওর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানাটি ছিল বেশ আরামদায়ক, দামি আর উন্নত। ছেলেটির এই সৌজন্যবোধে এতটা অভিভূত হলাম যে, চোখে পানি এসে গেল। ও  একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমি ঘুমুতে পারলাম না। ওর আচরণ মনে এমন রেখাপাত করেছিল যে, সারা রাত  আর আমার চোখে  ঘুম এল না।

সকালে আমাদের দুজনের ট্রেন একসাথেই এল। আমরা একে অপর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ ট্রেনে উঠলাম। ওর ব্যবহারে আমি তখন এমনই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, ঠিকানা রাখার কথাও মনে আসেনি। ঠিকানা না থাকায় পরবর্তীতে আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। এখন মনে হলে খুব খারাপ লাগে। জানি না এখন ও কোথায় আছে, কেমন আছে। এ ঘটনা মনে পড়লে ৪৩ বছর আগের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠে। অজান্তে চোখের কোণে অশ্রম্ন জমে। মন থেকে ওর জন্য দুআ আসে। জীবনে যদি আর একবার ওর সাথে দেখা হত, আর আমি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম! কিন্তু কত আশা বুকে নিয়ে মানুষকে কবরে চলে যেতে হয়...!

 

দুই. ৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত আমি বেরেলিতে ছিলাম। ইউ পি-এর যে কটা শহর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জন্য খ্যাত ছিল বেরেলি তার অন্যতম। এই বারো-তেরো বছরে বেশ কয়েকবার সহিংসতা হয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৪৬ সালের ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রশাসন কারফিউ দিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। কিছুদিন পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য ছাড় দেওয়া হয়। সকালে কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ বন্ধ থাকত। সাধারণ মানুষ যেন নিতান্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলো এ সময়ে সেরে নিতে পারে।

  আমার বাসা ছিল পূর্ব শাহাবাদ এলাকায়। (মরহুম মওলবী আবদুল কাইয়ুম সাহেবের এরিয়া)। এর চারপাশে মুসলিম জনবসতি। এরিয়ার একেবারে পাশঘেষে এলাকার মসজিদ। মাঝখানে শুধু একটি সড়ক। আমাদের এলাকা থেকে কিছুটা দূরে পূর্বপাশের প্রায় গোটা অঞ্চল ছিল হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। মসজিদ ও আমাদের এলাকার মাঝের সেই রাস্তাটিই ছিল তাদের চলাচলের রাস্তা। বাজারে বা অন্য কোনো জায়গায় যেতে হলে এ রাস্তা দিয়েই তাদের যেতে হত। 

কারফিউ বিরতি চলাকালীন একদিন সকালে আমি মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদের পাঁচিলের উপর উঠে রাস্তার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। একটু পর দেখলাম, একজন হিন্দু লোক বাজারের দিকে যাচ্ছে। নিতান্ত গরিব আর নিরীহ গোছের এক প্রেŠঢ়। খুব দ্রম্নত পা ফেলছিল। মনে হয় জরম্নরি কোনো কাজে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেলাম, দুটো বখাটে ছেলে লাঠি নিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছিল ছেলে দুটো মুসলমান। গায়ে ময়লা জীর্ণ কাপড়। আমার অপরিচিত, অন্য কোনো মহল্লার ছেলে হবে এরা। বুঝতে বাকি রইল না ওদের মতলব। পাঁচিলের উপর থেকেই ওদের জোরে ধমক দিলাম, এরপর দ্রম্নত নেমে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, খবরদার! কারো গায়ে যদি হাত তোলো তো আমি নিজে তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেব। ছেলে দুটো কিছু বলল না। চুপ করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি লোকটিকে কুলহাড়াপেড়-এর বাজারে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

একটু পর পাশের মহল্লা থেকে দুজন লোক এসে আমাকে বলল, আপনি এটা কী করলেন? রাস্তায় একটি হিন্দু লোককে সহায়তা করলেন আবার তার সাথে বাজার পর্যন্ত গেলেন, এদিকে হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের উপর কী নির্যাতনই-না করা হচ্ছে। আমি বললাম, কী হচ্ছে-না-হচ্ছে তা আপনার চেয়ে আমি ভালো জানি। আসলে গুজব বাস্তবতার তুলনায় ঢের বেশি। আর অন্য কোনো এলাকায় মুসলমানদের উপর নির্যাতন হলেই এ রাস্তায় চলাচলকারী নিরপরাধ হিন্দু জনসাধারণের গায়ে হাত দেওয়া জায়েয হয়ে যাবে? সাহস থাকে তো ঐ হিন্দু মহল্লায় গিয়ে কিছু করম্নন যেখানে মুসলমানদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তা-না করে নিরপরাধ হিন্দুদের কষ্ট দেওয়া কেন? এ কাজ ইসলামের আদর্শবিরম্নদ্ধ। অসহায় মানুষের গায়ে হাত তোলা কাপুরম্নষতা। এর চেয়ে ঘৃণ্য কাজ আর কী হতে পারে?

আমার কথা শুনে তারা বলল, দেখুন, ঝামেলা করবেন না; আমরা আপনাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, সামনে এসব সহ্য করা হবে না, আপনি যে ছেলেদের বাঁধা দিয়েছেন তারা আমাদের বলে দিয়েছে, আপনি যেন আর কখনো তাদের বাঁধা না দেন, অন্যথায় তারা আপনার মান-সম্মানের লেহাজ করবে না। আমি বললাম, আমিও আপনাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, এখন থেকে আমি নিয়মিত ঐ চৌরাস্তা পাহারা দিব এবং আমার পরিবারের কোনো ছেলেও যদি নিরপরাধ কোনো হিন্দুর দিকে হাত বাড়ায় তো কসম খোদার আমি তাকেও পুলিশে ধরিয়ে দেব। আমি বিশ্বাস করি, এটাই আমার প্রতি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ, এ কাজে যদি আমার জান যায় তো আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আমি শহীদের মর্যাদা পাব। জবাব শুনে যে তাদের ভালো লাগবে না তা তো স্পষ্ট, কিন্তু তারা কোনোরূপ উচ্চবাচ্যও করেনি। কয়েক ঘণ্টা পর ঐ মহল্লার আরেকজন লোক এল। দশাসই চেহারা, রূঢ় মেজাজ। বেশ রাগতস্বরে সে আমাকে বলল, আপনি এখানে বসে বসে হিন্দুদের পাহারা দিচ্ছেন আর এদিকে জাখিরাতে (একটি অঞ্চলের নাম) শত শত মুসলমানকে একটু আগে গুলি করে মারা হয়েছে। বন্দুক নিয়ে সংগঠিত হয়ে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর হামলা করেছে। কিছুক্ষণ আগে একটি লোক সেখান থেকে এসেছে। সে বলছে, ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষিত হচ্ছে, শত শত মুসলমান শহীদ হয়ে গেছে।

আমি বললাম, হতে পারে, এরকম হওয়া তো অসম্ভবের কিছু নয়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি ভালোভাবে খোঁজ-খবর না নিয়েই এ কথা বলছেন। এ রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া কথা দ্বারা হাঙ্গামা বাড়তে থাকে। চলুন আমরা কোতয়ালি যাই, সেখান থেকে কাউকে সঙ্গে নিয়ে জাখিরা যাব, তখন আসল হাকীকত উদ্ধার হয়ে যাবে। কথা শুনে সে আরও রেগে গেল। আমাকে বলল, আপনি চাইলে যেতে পারেন, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই যাব। মনে হল, গিয়ে দেখে আসলে এ সকল গুজব শক্তভাবে রোধ করতে পারব। মুশকিল হল, কারফিউ চলছিল, পুলিশের সহায়তা ছাড়া যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আল্লাহ ব্যবস্থা করে দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে একটু পর আমাদের রাস্তা দিয়ে একদল পুলিশ গেল। আমি তাদের একজনকে সাথে নিয়ে কোতয়ালি গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, সব উড়োকথা, জাখিরাতে আজ কিছুই ঘটেনি। ফিরে এসে মহল্লাবাসীকে সব খুলে বললাম। কিন্তু আশ্চর্য, যে লোকটি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষিত হওয়ার, শত শত মুসলমানের লাশ পড়ে যাওয়ার খবর নিয়ে এসেছিল সে এরপরও ঘাউড়ামি করছিল। আসলে এ ধরনের লোক মুসলমানদের জন্য শত্রম্নর চেয়েও ক্ষতিকর। আল্লাহ আমাদের শুভবুদ্ধি দান করম্নন।

সে সময় সরকারিভাবে রেশন দেওয়া হত। এই গোটা অঞ্চলের জন্য সরকারি খাদ্যদ্রব্যের দোকান ছিল আমাদের চৌহদ্দিতে। আমি জানতে পারলাম, এলাকার অনেক হিন্দুবাসিন্দা নিরাপত্তার অভাবে খাবার-খাদ্য কিনতে এই চৌহদ্দিতে আসে না। এ কারণে কিছু দরিদ্র পরিবারে উপোস চলছে। সকালে যখন কারফিউ বিরতি চলে সাধারণত লোকেরা তখন খাবার কিনতে আসে। এ সময়টুকু যদি পাহারার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ সময়ে রাস্তা পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এলাকার কিছু যুবকও আমার সাথে পাহারার কাজে অংশ নিল। যতদিন পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ছিল ততদিন আমরা পাহারার কাজ করেছি। একটি আফসোস আমার থেকে গেছে, শহরের আরও কিছু অঞ্চলের পরিস্থিতি আমাদের এলাকার মতই ছিল। তখন আরেকটু ভাবলে এবং হিম্মতের পরিচয় দিতে পারলে শহরের আরও কিছু এলাকায় এ রকম পাহারার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু তখন তা মনে আসেনি।

(ভাষামত্মর : হুজ্জাতুলস্নাহ)

 

 



[1] ৪০-৪৫ বছর আগে গাজীয়াবাদ স্টেশনের অবস্থা  যে  কত সাধারণ ছিল তা এখন কল্পনাও করা যায় না।

 

 

 

advertisement