যিলক্বদ ১৪৩৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৪

ওলিদের আলোচনায় দিল তাজা হয় : হযরত মাওলানা আবদুল হালীম রাহ. (ওলামাবাজার হুযুর)

মাওলানা ইসহাক ওবায়দী

 

পটিয়া মাদরাসায় প্রায় তিন বছর পড়ার পর একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাওয়ায় নোয়াখালীর সবচেয়ে বড় মাদরাসা ফেনী দারুল উলূম আলহুসাইনিয়া ওলামাবাজার মাদরাসায় এসে আমি ভর্তি হই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওলামাবাজারের আমলী পরিবেশ আমার মধ্যে দারুণ প্রভাব ফেলল। আমি একদম সোজা হয়ে গেলাম। পড়ালেখা আর আমলী কাজ ছাড়া আর কিছু করতে মন তেমন সাড়া দিত না। এর প্রধান কারণ আমার যা মনে হয়েছে, তখনকার বড় হুযুর হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব (ওলামাবাজারের হুযুর)-এর আকাশচুম্বি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। প্রায় ৮/১০ মাইল পায়ে হেঁটে মাদরাসায় যাওয়ার সময় মাঝ পথে ছোট ফেনী নদী পার হতেই আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ত। মনে মনে ভাবতাম, আমি এখন অসাধারণ পরিবেশে যাচ্ছি, যেখানে সব আল্লাহর ওলিরা বাস করেন। এসব ভেবে ভেবে নিজেকে শুধরে নিতাম এবং আমি নিজেও ঐ পরিবেশের একজন ক্ষুদে সদস্য হয়ে যেতাম। আমার জীবনে এতটা পরিবর্তন আর কখনো হয়নি, এমনকি এই বৃদ্ধ বয়সেও নয়।

ওলামাবাজারের হুযুর বাড়ি থেকে সকাল ৯টা ১০টার দিকে মাদরাসায় আসতেন। বহুদূর থেকে হযরতের আগমন দেখা গেলে মাদরাসার অবস্থা আরো ফেরেশতাসুলভ হয়ে যেত। হযরত নিচের দিকে তাকিয়ে পথচলার সময় মাঝেমধ্যে চোখ তুলে তাকালে এদিকে মনে হত কেয়ামত বরপা হয়ে গেছে। হযরতের গুরুগম্ভীর চলন-বলন উস্তায-শাগরিদ সকলের অন্তরেই ক্রিয়া করত। হযরতের কামরাটি মাদরাসার প্রবেশপথ বরাবর হওয়াতে সকলের চলাফেরা হযরতের চোখে পড়ত, তাই সবাই সাবধানে চলাফেরা করত। হযরতের মেযাজে হিদ্দত বা গরমী গালেব ছিল। তাই হযরতের ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপত। ছাত্র-শিক্ষক সকলের এছলাহ খুসুসীভাবে না করে আমভাবে করাকে তিনি বেশী পছন্দ করতেন। যেমন কারো কোনো বেলাগামী বা অপছন্দনীয় কাজ দেখলে বা শুনলে বাদ যোহর হযরত দাঁড়িয়ে যেতেন এবং সবাই জমে বসার পর বয়ান শুরু করতেন। বয়ানের মাঝে ঐ বিষয়টিকে তুলে ধরে কারো নাম না নিয়ে এমনভাবে যজর ও শাসন করতেন যে, যার বিষয় সে তো বুঝতে  পারতোই, অন্য সবাইও হুঁশিয়ার হয়ে যেত।  এভাবে এছলাহ করার ক্ষেত্রে একজনের পরিবর্তে কয়েকশ মানুষের এছলাহ করা হযরতের মাকসুদ থাকত।

মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাওলানা হাকিম আবদুল হক ছাহেবের ছোট ছেলে মোজ্জাম্মেল আমাদের সাথী ছিল। মাদরাসার প্রথম পাকা ভবনের কাজ করার সময় সূফী সিদ্দীক সাহেব সকলকে পানি পান করাচ্ছিলেন। একজনের পান করা ঝুটা পানির সাথে নতুন করে পানি ঢেলে মোজ্জাম্মেলকে দেয়াতে সে ঝুটা পানি বলে সবটাই ফেলে দেয়। সূফী সাহেব নেক লোক ছিলেন বলে এছলাহের নিয়তে হুযুরের কানে কথাটা পেড়ে বসলেন। ব্যস, যোহরের পর কোনো বুযুর্গের উক্তি سور المؤمن شفاء للناس   দিয়ে হযরত বয়ান আরম্ভ করলেন। سور المؤمن  শব্দটি আম বা ব্যাপক শুধু মুমিনের ঝুটা হলেই হল। আবার شفاء  শব্দটিও আম। শেফায়ে জিসমানী ও শেফায়ে রূহানী দুটোই হতে পারে। আবার للناس শব্দটিও আম للمؤمن বলা হয়নি। অর্থাৎ যে কোনো মুমিনের ঝুটা সমস্ত মানুষের জন্য শারীরিক ও আত্মিক সমস্ত রোগের শেফা বলা হয়েছে। বিষয়টাকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করলেন যে, যার বিষয়ে বলা হয়েছে তার তো উপকার হয়েছেই, মাঝখানে আমরা কয়েকশ ছাত্র-শিক্ষকের কাছেও বিষয়টি চিরদিনের জন্য স্মরণ রাখার মত ব্যাপার হয়ে গেল। এই আম বয়ান বা এছলাহের দরুণ আমার নিজের এত উপকার হয়েছে যে, জীবনে কোনো মুমিনের ঝুটার প্রতি আর ঘৃণা হয়নি; বরং আন্তর্জাতিক হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল  ও হোটেল সোনারগাঁয়েও এর ওপর আমল করতে আমার কোনোদিন দ্বিধা-সংকোচ হয়নি। আমাদের আসাতেযায়ে কেরামের মধ্য থেকে কারো কোনো বিশেষ দিকের প্রতি আলোকপাত করতে হলেও হযরতের আদত ছিল আম বয়ানের। যাতে করে বিষয়টির প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে আর অপরদিকে অন্য শ্রোতাদেরও যেন সে বিষয়ে পূর্ণ এছলাহ হয়ে যায়। ওলামাবাজার মাদরাসার বর্তমান বড় হুযুর (তখনকার নায়েব ছাহেব) হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ ছাহেব, শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুস্তফা ছাহেব ও হযরত মাওলানা মাকসুদুল্লাহ ছাহেব (ফাযেল ছাহেব হুযুর) ব্যতিত অন্য সবাই হযরতের শাগরেদ অথবা মুরিদ ছিলেন। তারপরও এঁদের কোনো বিষয়ে সতর্ক করতে হলেও হযরতের ঐ আম নসীহতই কার্যকর হত। কারো নাম না নিলেও আমরা কার বিষয়ে বলছেন অনেক সময় বুঝে ফেলতাম। এরপরও দেখতাম এসকল বুযুর্গ মাথানত করে হযরতের যজর ও এছলাহকে বরণ করে নিতেন। একেই বলে ফানায়িয়্যত। তাঁরা নিজেদেরকে ফানা করার কারণে তাঁদের মর্যাদা আজ আমাদের ছাত্রদের কলবেও শতগুণ বেশি দেখতে পাই। হযরতের এই এছলাহি বয়ান কোনো কোনো সময় আছর পর্যন্তও চলত। দরস-তাদরীস ও হেফযখানাসহ সব সবকই এ সময় মুলতবী থাকত। তালীমের সাথে তরবিয়তের এই নমুনা আজ বিরল বললেই চলে।

মানুষের এছলাহ দুইভাবে করা যায়। ডেকে খুসুসীভাবে যার বিষয় তাকে সতর্ক করা অথবা এভাবে আম মজলিসে হেদায়েত করা। তবে এই আম পদ্ধতি আমাদের সকলের জন্য প্রয়োগ করা মোনাসেব নয়। কারণ, এতে অনেক সময় ফেতনার আশংকা থাকে। তবে হযরতের শান যেহেতু নিরালা ছিল তাই হযরতের মত লোকের জন্য তা মানাতো। আজকালের তবিয়ত হিসেবে খুসুসী তরিকায় এছলাহ করাই বেশি মোনাসেব।

হযরতের পড়ালেখা ছিল সরকারী মাদরাসায়। বসুরহাট আলিয়া মাদরাসা থেকে ছুয়াম পাশ করার পর হযরত কোলকাতা আলিয়া মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হন। পড়ালেখায় হযরত অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। কোনো কোনো সময় বলে ফেলেছেন যে, মাকামাতের মত কঠিন কিতাবের পরীক্ষায় প্রায় ৪৮ পৃষ্ঠা লিখে ফেলার পর ঘণ্টা শেষ হয়ে যাওয়াতে হযরতের খাতা নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ হযরত মনে করছিলেন যে, আরো এক ঘণ্টা লিখতে পারবেন। ব্যাপারটা এভাবে ঘটেছিল যে, হযরতের কোনো সহপাঠি লিখতে না পারার জন্য হিংসা করে হযরতের ঘড়িকে কোন ফাঁকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছিল। হযরত তো ঘড়ি দেখে দেখে লিখছিলেন এবং মনে করছিলেন যে, আরো এক ঘণ্টা লেখার সুযোগ আছে। অথচ ঘড়ি পিছিয়ে দেয়ার কারণে সঠিক সময় হযরতের জানা না থাকায় আরো বহু পাতা লিখতে পারলেন না। এর জন্য হযরত আফসোস করতেন। পক্ষান্তরে যা লিখেছেন তাও ছিল প্রায় ৪৮ পাতার মতো। এতেই হযরতের মেধা আঁচ করা যায়।

হযরতের উস্তাযরাই পরামর্শ দিয়ে হযরতকে কোলকাতা পাঠান। হযরত কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে সোনার মেডেল নিয়ে টাইটেলে ফার্স্টক্লাশ পান। হযরতের আববার এ নিয়ে খুব গর্ব ছিল। কিন্তু হযরত সোনার মেডেলকে তেমন দাম দিতেন না। হযরত বলেন যে, মেডেলটি একদিন ঘর থেকে চুরি হয়ে যাওয়ায় আমার খুব ভালো লেগেছিল। হযরত কোলকাতা আলিয়াতে ৪ নং ইলিয়া হোস্টেলে থাকতেন। হযরতের রুমমেট ছিলেন পরে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ আমার চাচা হযরত মাওলানা ইয়াকুব শরীফ ছাহেব। শরীফ ছাহেব হযরতের নিচের ক্লাশের ছাত্র হলেও একই রুমে থাকতেন। আমি এবং মরহুম হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ ছাহেব কোলকাতার সফরে হযরতের থাকার ঐ ৪নং রুমটি যেয়ারত করেছিলাম।

হযরত আমাকে আমার চাচার কারণেও বেশি নেক নজরে রাখতেন। চাচা থেকে দাদাজানের মর্তবা ও কারামত সম্পর্কে জেনে এবং তাঁর সুন্নতের সায়দায়ী হওয়ার কথা শুনে শুনেও আমাকে বেশি মহববত করতেন। হযরতের সবচেয়ে বড় কারামত হল, প্রতিটি কাজে সুন্নত তালাশ করে করে তার ওপর আমল করা।

অধম লেখককে হযরত কাফিয়া পড়ার বছর বাইয়াত করলেন। অথচ আমার সাথে যারা বাইয়াতের দরখাস্ত করেছিলেন তাদেরকে অনেক শর্ত-শারায়েত ও পাবন্দী লাগিয়ে দেন। পক্ষান্তরে আমার ব্যাপারটি হযরত বিনা শর্তেই মনযুর করলেন। হযরতের এই শফকতকে কাজে লাগাতে পারিনি বলে আজ বড় দুঃখ হয়। কিন্তু দুঃখ করে কি হারানো মানিক পাওয়া যায়? নিজের বদ আমলীর কারণে হযরতের কাছ থেকে কিছুই অর্জন করতে পারলাম না।

হযরত যখন বসুরহাট মাদরাসার উস্তায ছিলেন সে সময় হযরত শর্শদী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা সূফী নূর মুহাম্মদ ছাহেব হুযুরের কাছে বাইআত হন। প্রতি সপ্তায় পায়ে হেঁটে পীরের দরবারে শর্শদীতে হাযেরী দিতেন এবং আপন পীর থেকে আখলাক ও কামালাত হাসিল করতেন। তাঁর পীর হযরত সূফী নূর মুহাম্মাদ ছাহেবই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের পীর (হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.)- কে না দেখেও খেলাফত লাভ করেছিলেন। খেলাফত লাভের পর থানাভবন গিয়ে শায়খের সাথে প্রথম মোলাকাত করেন। ওলামাবাজারের হুযুরকে যখন সূফী ছাহেব হুযুর এজাযত দেন তখন সূফী ছাহেবের খাছ খাদেম হযরত মাওলানা নূরুল্লাহ ছাহেবের (লন্ডনের হুযুর) মারফত এজাযতনামা লিখে পাঠানো হয়। লন্ডনের হুযুর নিজে আমাকে বলেছেন, আমি তখন হুযুরের ছাত্র ও খাদেম ছিলাম। আমার কাছে যখন এজাযতনামা দিয়ে পাঠানো হয় আমি তখন এজাযতনামা নিয়ে বামনি হযরতের বাড়িতে যাওয়ার পথে হযরতের সাথে সাক্ষাৎ হয়। হযরত মাদরাসায় আসছিলেন। হযরত দূর থেকে আমাকে দেখেই থেমে গেলেন। আমি সালাম-কালামের পর এজাযতনামাটি হাতে দিলে হযরত অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে যান। সূফী নূর মোহাম্মাদ ছাহেবের সর্বমোট খলিফা ছিলেন মাত্র চারজন। কলাকোপা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা সায়ীদুল হক ছাহেব, হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব, হযরত মাওলানা শহীদ নযীর আহমদ ছাহেব ও বগুড়ার হযরত মাওলানা নজীবুল্লাহ ছাহেব। আল্লাহর অশেষ মেহরেবানী যে, চারজনকেই আমার দেখার ও সোহবত গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছে।  

হযরতের তাকওয়া ও ফেরাসাত এত সূক্ষ্ম ছিল যে, সামান্য শক-শোবা ও সন্দেহ হলেই তা বর্জন করতেন। একবার আখের মৌসুমে আমার খেয়াল হল যে, আমার শ্রদ্ধেয় চারজন উস্তাযকে আখ খাওয়াব। যথারীতি বড় হুযুরের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলে হযরত অনুমতি দিয়ে দেন। বর্তমান হযরত ও আদীব ছাহেব হুযুর এবং হযরত মুহাদ্দেস ছাহেব হুযুর থেকেও অনুমতি নিলাম। তাঁরা সবাই যথারীতি খুশি খুশি আমার আখের দাওয়াত কবুল করলেন। কোনো এক নামাযের পূর্বে ওলামাবাজারের হুযুর অযু করতে বসে ইশারা করে আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে যাওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ছোট ভাইয়ের টাকা কি তোমার টাকার সাথে একসাথে মানি অর্ডারে আসে? আমি উত্তরে বললাম, জ্বি হজরত! হযরত বললেন, তাহলে? অর্থাৎ তাহলে কী করে খাব? আমি তখন ওপরের জামাতের ছাত্র হওয়ায় মাসআলাটা বুঝে ফেললাম যে, আমার ছোট ভাইটি নাবালেগ হওয়াতে হযরত আর খাবেন না। কারণ, না বালেগের মাল নাবালেগ নিজেও কাউকে দিতে পারে না, অন্যদিকে নাবালেগের মাল খাওয়াও যাবে না। এখানে শুধু নাবালেগের টাকাটা আমার টাকার সাথে মিশ্রিতভাবে আসায় হযরত আর দাওয়াত কবুল করলেন না বলে আমার বুঝে আসলো। এত সূক্ষ্ম তাকওয়া আমি খুব কমই দেখেছি।

ওলামাবাজার নামকরণের একটি ইতিহাস আছে। ইতিহাসটি হল, অত্র এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মাওলানা হাকিম আবদুল হক ছাহেব (যিনি প্রায় ২৩ বছর যাবত অত্র এলাকার চেয়ারম্যানও ছিলেন) দেশ বিভাগের পূর্বে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নেতা ছিলেন। সোনাগাজী বাজার ছিল মুসলিমলীগারদের প্রভাবে পরিচালিত। আর মুসলিমলীগাররা ওলামায়ে হিন্দের লোকদের ওপর নির্যাতন করত। তাই হাকিম ছাহেবসহ অন্য নেতৃবৃন্দ সোনাগাজীর পশ্চিমে প্রায় নদীর কাছে একটি বাজার মেলানোর চেষ্টা করলেন। তাঁরা মনে করলেন বাজারের প্রধান পণ্য মাছ যেহেতু আমাদের নদী থেকে যায় তাই আমরা সোনাগাজীতে মাছ যেতে দেবো না। এখানে বিক্রি করার প্রস্তাব করব। যেমন চিন্তা তেমন কাজ, তাই করা হল। সব মাছ বিক্রি না হলে হাকিম ছাহেব নিজেই নাকি বাকী মাছ খরিদ করে নিয়ে যেতেন। এভাবে এখানে একটি বাজার স্থাপিত হয়ে যায়। যার নাম পড়ে যায় ওলামাবাজার। যেহেতু ওলামায়ে হিন্দের লোকেরা তা করেছিল তাই বাজারের নামও ওলামাবাজার হয়ে যায়। কিছুদিন পর নেতৃবৃন্দ সেখানে একটি মাদরাসার প্রয়োজন অনুভব করলেন। প্রথম দিকটায় জায়গা না পাওয়া পর্যন্ত নাকি বাজারের নামাযের স্থানেই মাদরাসার পড়াশোনা আরম্ভ হয়। পরে একখন্ড জায়গা পাওয়ার পর বক্তার মুন্সি মাদরাসার শিক্ষক হযরত মাওলানা ফজলুল হক ছাহেবের জন্য ওলামায়ে হিন্দের সমর্থনের কারণে সেখানে চাকরি করাটা দুষ্কর হয়ে পড়াতে হাকিম ছাহেবরা তাঁকে এই মাদরাসায় নিয়ে আসেন। হযরত মাওলানা ফজলুল হক ছাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাদরাসাটি সুচারুভাবে চলতে আরম্ভ করে। ইতমধ্যে মাদরাসার আরো শ্রী বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি একজন মোখলেছ উস্তাযের তালাশ করছিলেন। পরে আমাদের আলোচ্যব্যক্তি হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেবকে বসুরহাট থেকে এই মাদরাসায় নিয়ে আসেন। যেহেতু ওলামায়ে হিন্দের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়দ হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. তাই মাদরাসার নামকরণেও তাঁর নাম যোগ করে মাদারাসার নাম হয় দারুল উলূম আলহুসাইনিয়া মাদরাসা। এ যেন বাজারকে উপলক্ষ করে মাদরাসা ও মসজিদ, সর্বোপরি কিছু জাদরেল সমর্থক ওলামার সমন্বয়ে ওলামায়ে হিন্দের একটি দূর্গ গড়ে তোলা হয়।

হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেবের প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে মাদরাসার উত্তর-উত্তর শ্রী বৃদ্ধির সাথে সাথে দূরদূরান্তে তার নামডাক ও শোহরত হতে লাগল। আল্লাহর কী মর্জি, এরইমধ্যে হযরত মাওলানা ফজলুল হক ছাহেবের  ইন্তেকাল হয়ে যাওয়াতে হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব হুযুরকে সবাই মুহতামিম বা পরিচালক বানিয়ে দেন। হযরতের নিষ্ঠা ও নিরন্তর শ্রমের বদৌলতে মাদরাসাটি বৃহত্তর নোয়াখালীর অন্যতম প্রধান ও বড় মাদরাসায় রূপান্তরিত হয়। প্রায় পঞ্চাশ বছরের মত তিনি এই মাদরাসায় সুনামের সাথে দরস-তাদরীস ও পরিচালনার দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।

হযরতের জানেছার ও ফেদায়ী মুরিদ ছিলেন মরহুম হাজ্বী নুরুল ইসলাম ছাহেব। হযরতের মহববতের কারণেই হযরতের বড় সাহেবযাদা জনাব ভাই হাফেয ফখরুল ইসলামের কাছে তার বড় মেয়েকে বিয়ে দেন। হাজ্বী সাহেব বাংলাদেশের একসময়ের প্রধান ধনাঢ্য ব্যক্তি হাজ্বী জহুরুল ইসলাম সাহেবের সাথে ঠিকাদারী ব্যবসা করতেন। তাঁর সুবাদেই হাজ্বী জহুরুল ইসলাম সাহেব ওলামাবাজার হুযুরের সোহবত-সান্নিধ্যে আসেন এবং হুযুরকে খুব বেশি ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। তাঁর পল্টনের বাড়িতে হুযুরের জন্য সবসময় একটি রুম বরাদ্দ করা ছিল। মাদরাসার কাজে হযরতের ঢাকা আগমন হলে ঐ রুমটায় হযরতের থাকার ব্যবস্থা হত। হযরতের ওপর ফেদায়ী হওয়ার কারণে হাজ্বী জহুরুল ইসলাম সাহেব বরকতের জন্য তাঁর দুবাইয়ের ঠিকাদারীর কাজের উদ্বোধন করান হুযুরকে নিয়ে গিয়ে। ওলামাবাজার মাদরাসায় এই দুই হাজ্বী সাহেবের বহু অবদান আছে। হাজ্বী নূরুল ইসলাম সাহেব হযরতের এত আশেক ছিলেন যে, তিনি আমাদেরকে পর্যন্ত কখনো কখনো বলতেন, আপনারা হুযুরকে চিনতে পারেননি এবং কদরদানীও করতে পারছেন না।

হযরতের উপর আরো ফেদায়ী ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালীর তাবলীগ জামাতের অন্যতম মুরববী জনাব যায়েদুল হক কেরানী সাহেব। চৌমুহনীতে তাঁর নযীর তিনি নিজেই ছিলেন। দাওয়াত ইলাল্লাহর পথে তিনি নিজেকে কোরবান করে দেন এবং শত শত আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহমুখী করতে সক্ষম হন। হযরতের জায়গিরবাড়ি পাটওয়ারী বাড়ির ছোটমিয়া সাহেব এবং পোস্টমাস্টার সাহেবদের হযরতের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার যে আচরণ ছিল তা কেউ দেখলে হুযুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামদের ভক্তি-শ্রদ্ধার ইতিহাস স্মরণ না করে উপায় ছিল না। যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের ভক্তি-শ্রদ্ধা আমরা দেখিনি শুধু হাদীসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, তাই আমাদের মনে হত তাঁদের ভক্তি-শ্রদ্ধার ভাব কিছুটা প্রকাশ পেত এই দুইজন মুরুবিবর ভক্তি-শ্রদ্ধার মাধ্যমে।

আরেকজন ফেদায়ী দেখেছি আমাদের সাথী মধুপুরের পীর ছাহেব জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ ছাহেবকে। হযরতের ওপর জান কোরবান করে দিতে সদা তিনি প্রস্ত্তত থাকতেন। মধুপুর মাদরাসার নামই রেখেছেন হালিমিয়া মাদরাসা। পড়ালেখায় তত মেধাবী না হয়েও এই ফেদায়িয়্যাতের কারণেই তিনি আজ এত সফল দ্বীনের খাদেম হিসেবে কাজ করতে পারছেন। আমরা যারা ফেদা হতে পারিনি তারা আজ জগতের কোনো কাজেই লাগতে পারলাম না বলে শত দুঃখিত ও মর্মাহত। এখন শুধু হায় আফসোস-হায় আফসোস করেই জীবন যাচ্ছে।

হযরত রাহ. এসলাহ ও সুলুকের ক্ষেত্রে সালাফের তরিকায় কাজ করতেন। হযরত বলতেন, সুন্নতই বেলায়েতের জন্য শাহরাহের অবস্থানে আছে। এমনকি যিকির-আযকারের ব্যাপারেও মাছূর যিকিরকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। সূফিয়ায়ে কেরামের ১২ তাসবীহকে হযরত ১৩ তাসবীহ বলতেন। মুফতিয়ে আযম ফয়জুল্লাহ ছাহেব রাহ. ও হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ.-এর মাশরাব-মাসলাককে বেশি প্রাধান্য দিতেন।

হযরতের কুরআন তেলাওয়াত ছিল অত্যন্ত মধুর ও দিলকাশ। কেরাতের কিতাব শরহে জাযারী পড়ার পর হযরতের মধ্যে এক বিশেষ হাল পয়দা হয় যে, হায়, আমরা তো আলফাযে কুরআনও ঠিক বিশুদ্ধভাবে পড়ছি না। উজানীর হযরত কারী ইব্রাহীম ছাহেব রাহ.-এর ব্যাপারে বলতেন যে, তাঁর নাকি মক্কা শরীফে তাঁর উস্তাযের কাছে ÔطÕ হরফটি মশক করতেই ১৫ দিন লেগেছিল। হযরত বলতেন, তাহলে আমাদের তো ১৫ মাস লাগলেও কম বলতে হবে। হযরতকে দেখতাম, আমাদের আসাতেযায়ে কেরামকে নিয়ে বহু মাস পর্যন্ত আছরের পর কেরাতের মশক করাতেন। এরপর উস্তাযরা প্রতিটি জামাতকে নিয়ে আছরের পর মশক করাতেন। হযরত বলতেন, যদি কারো সমস্ত কুরআন বিশুদ্ধ আছে বলে মনে করে কোনো চেষ্টা না করে আর একটি হরফ অশুদ্ধ থেকে যায় তাহলে কাল কেয়ামতের মাঠে মহান আল্লাহ পাক ঐ একটি হরফের জন্যও পাকড়াও করতে পারেন। পক্ষান্তরে যদি কেউ সমস্ত কুরআন শরীফ ভুল থাকা অবস্থায় হরদম তা শুদ্ধ করার পেছনে লেগে থাকে ও বেচাইন থাকে তাহলে মহান আল্লাহ পাক তাকে ঐ চেষ্টা ও ভয়ভীতির কারণে তার ঐ সমস্ত অশুদ্ধকেও মাফ করে জান্নাতের ফায়সালা করতে পারেন। কুরআন নিয়ে হযরতের এই পেরেশান হাল বসরকে বসর পর্যন্ত বহাল থাকতে দেখেছি।

হযরতের আরেকটি হাল দেখেছি, নামাযের রুকু-সাজদা ও কওমা-জলসা ইত্যাদি ঠিক করার ব্যাপারে এত যত্নবান ও পেরেশান থাকতেন যে, বড় বড় মাহফিলেও নিজে রুকু ও কওমা ইত্যাদি করে করে মানুষকে দেখাতেন।

হযরত কোনো বিষয়ে তাহকীক করতে চাইলে তার আদ্যপান্ত খবর নিয়ে ছাড়তেন। যেমন ضالين -এর মধ্যে কালমী মুছাক্কাল আছে আর آلآن -এর মধ্যে কালমী মুখাফ্ফাফ, এ দুটির প্রভেদ হওয়া দরকার। হযরত বলতেন, করাচির কারী ফতেহ মোহাম্মাদ ছাহেব ضالين -কে ঝটকা দিয়ে পড়তেন। তদ্রূপ হারামাইন শরীফাইনের ইমাম সাহেবরাও তা একটু ঝটকা দিয়েই পড়তেন। হযরত বলতেন, তাঁদের পড়া প্রথম প্রথম আমার কাছেও কেমন যেন লাগত। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যে, তাঁরাই বিশুদ্ধ তেলাওয়াত করছেন আর আমরা ভুল পড়ছি। তাই হযরত এ ব্যাপারে মশক করানো আরম্ভ করে দিলেন। ওলামাবাজার মাদরাসায় তখন কারী সিদ্দীক ছাহেব নামে একজন বড় কারী ছিলেন। তিনি হযরতের এই ঝটকা দিয়ে পড়াকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি ভারত থেকে তাঁর উস্তাযকে নিয়ে আসলেন। ঐ উস্তায কারী ছাহেব ওলামাবাজার মাদরাসায় মাসাধিককাল পর্যন্ত মেহমান ছিলেন। ভারতের কারী ছাহেব এসে হযরতের তাহকীককেই বহাল রাখলেন। শাগরেদেরটা নয়।

হযরতের হাজার হাজার শাগরেদীনের মধ্য থেকে আজাল্লে শাগরিদের সংখ্যাও খুব কম নয়। আমার তো সকলের বিষয় জানা নেই। তবে আমার দৃষ্টিতে এক নাম্বার আজাল্লে শাগরিদ হচ্ছেন ওলামাবাজার মাদরাসার বর্তমান শাইখুল হাদীস ওয়াল আদব হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেব (আদীব ছাহেব হুযুর)। হুযুর আমারও অনেক প্রিয় উস্তায। আর হযরতের খলিফাদের সংখ্যা বা তালিকা আমার জানা থাকলেও আজাল্লে খলিফা হচ্ছেন ওলামাবাজার মাদরাসার প্রায় ৫০ বসর যাবত সহীহ বুখারীর দরসদাতা মুহাদ্দিস আমার অতি প্রিয় উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আহমদ করিম ছাহেব (মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর)। দ্বিতীয়: ওলামাবাজার মাদরাসার বর্তমান শাইখুল হাদীস ওয়াল আদব হজরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেব (আদীব ছাহেব হুযুর)। তৃতীয়: বাংলাদেশের কওমী মাদারেসের শিক্ষক-প্রশিক্ষক, এদেশের নাহু ছরফ চর্চার ইমাম যাকে বলা হয় হযরত মাওলানা শিববীর আহমদ ছাহেব চরমটুয়াভী। আল্লাহর ফজলে এই তিনজনই এখনো বা-হায়াত আছেন। আল্লাহ পাক তাঁদের আরো হায়াতে তাইয়্যেবা নসীব করুন, আমীন।

ওলামাবাজার হযরতের মূল বাড়ি ছিল ছোট ফেনী নদীর পশ্চিম পাড়ে বামনি এলাকায়। হযরত সেখান থেকে হিজরত করে ওলামাবাজারের পূর্ব সোনাগাজী বাজারের পাশে হযরতের জায়গীর বাড়ি পাটওয়ারি বাড়ির পাশে একখন্ড জমিতে বসবাস শুরু করেন। তার বাড়িটি ছিল একটি ছনের ঘর, যার চতুর্পাশ্বে সুপারির ডগার বেড়া ছিল। আমার একবার মারাত্মক রোগ হলে চট্টগ্রামে আমার আববাজানকে টেলিগ্রাফ করা হয়েছিল। আববাজান এর পূর্বে আর কোনোদিন ওলামাবাজার যাননি এবং হযরতের সাথেও পরিচয় হয়নি। কিন্তু পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সুপারির ডগার বেড়া ঘেরা বাড়িটি দেখে হযরতের বাড়ি হতে পারে বলে ভেবে রেখেছিলেন। আমাকে পরে জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম, জ্বি ওটাই হযরতের বাড়ি। তখন আববাজান বললেন, ওলিদের বাড়ি দেখেই চেনা যায়। এখন আলহামদু লিল্লাহ বাড়ির সামনে হযরতের নামানুসারে একটি বড় মাদরাসা ও মসজিদ স্থাপিত হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলের হযরতের বড় সাহেবযাদা ভাই হাফেয ফখরুল ইসলাম ছাহেব। কদিন আগে শুনলাম তিনি গত ৪ঠা জানুয়ারি ২০১৪ ঈ. দিবাগত রাতে এন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি শুনে যেয়ারতে গিয়েছিলাম। এখন এ হালিমিয়া মাদরাসার দায়িত্বে আছেন তাঁরই সাহেবজাদা জনাব মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব। আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন এবং মাদরাসাটিকে কবুল করে নিন, আমীন।

দ্বীনের হামাগীর ফিকিরের সাথে সাথে ওলামাবাজার মাদরাসার ফিকিরই হযরতকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকত সবসময়। যার দরুণ হযরতকে সবসময় সফর করতে হত। তবে মাদরাসার জন্য চাঁদা সংগ্রহের ব্যাপারে হযরতের তর্য-তৌর একটু ভিন্ন ছিল। চাঁদার জন্য কাউকে খাছ খেতাব করতেন না। মুহিববীনদের কাছে মাদরাসার জরুরতগুলো পেশ করতেন এবং দুআ চাইতেন। এতে যার যার নসীব হত সাহায্য করতেন। পাকিস্তান আমলে হযরত ঢাকা ও করাচি সফর করতেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা-চট্টগ্রামেই হযরতের সফর সীমাবদ্ধ থাকত। তবে দাওয়াতী কাজে সমগ্র দেশেই তাঁর সফর হত। হযরত বৃটিশ আমল থেকেই দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। হযরত বলতেন, দিল্লীর নিযামুদ্দিন মারকাযে তখনকার লোহার চেয়ারে বসেও হযরত বয়ান করেছেন। হযরতের এই সম্পর্ক ছিল আজীবন । একাত্তরের যুদ্ধের পুরোটা সময় হযরত পাকিস্তানে তাবলীগি সফরে ছিলেন। গেছেন এক বছরের সময় নিয়ে। যুদ্ধের কারণে ১৪ মাস থেকে রেডক্রসের মাধ্যমে হযরত দেশে ফিরে আসেন। হযরত সরকারী মাদরাসার পড়ুয়া হওয়ার কারণে নিজেকে ত্রুটিযুক্ত মনে করতেন। তবে মাঝে মধ্যে হাসির ছলে বলতেন, আমি সরকারী হলেও আপনাদের হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর দরস ও সোহবত সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য নসীবে হয়েছে।

মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে মাদরাসার কাজে হযরত একবার লন্ডন সফরে যান। দ্বিতীয়বার লন্ডন হয়ে আমেরিকা সফর করেন। সফর থেকে ফিরে আসার  পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু সুস্থ হলে ১৯৯১ ইংরেজী সালের ২ রা ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ৭৯ বছর বয়সে হযরত তাহাজ্জুদ পড়তে উঠে হঠাৎ স্ট্রোক করে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরদিন সকালে কী একটা কাজে হযরতের মুরিদ রামপুরা রোডের হাজ্বী আয়াতুল্লাহ সাহেবের বাসায় আমার যাওয়া পড়ে। বাসা থেকে বলা হল ওলামাবাজারের হযরত ইন্তেকাল করেছেন তাই তিনি ওলামাবাজার গেছেন। আমি ইন্নালিল্লাহ পড়তে পড়তে এবং কাঁদতে কাঁদতে বাসায় যাই এবং সাথে সাথে সায়েদাবাদ যাই। সেখানে দেখি আমাদের সাথী ও পীর ভাই মধুপুরের পীর ছাহেব জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ ছাহেবও উপস্থিত। উভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওলামাবাজার যখন পৌঁছি ততক্ষণে জানাযা হয়ে দাফন-কাফন হয়ে গেছে। অগত্যা যেয়ারত ছাড়া আর কিছু কপালে জুটেনি। মহান আল্লাহ পাক হযরতের কবরকে গারীকে রহমত করুন এবং হযরতের মাগফিরাত নসীব ও দারাজাত বুলন্দ করুন, আমীন।

ওলামাবাজার হযরত বৃহত্তর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানাধীন চর বড়ধলী (বামনি) গ্রামে ১৩২১ বাংলা সনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম  মুনশি সিরাজুল হক আমিন। দাদার নাম হাবীবুর রহমান। মাতার নাম শরীফা খাতুন। তার পিতা ও দাদা শেষ জীবনে অত্যন্ত দ্বীনদার পরহেযগার মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

ওলামাবাজার মাদরাসায় তিনি ৩৭ বছর মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমে দ্বীন হিসেবে তিনি বরেণ্য ছিলেন। তিরি তাঁর শায়খ সুফী নূর মুহাম্মাদ রাহ.-এর ইন্তেকালের পর শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.-এর বাইআত ও তালাম্মুয ইখতিয়ার করেন। ৬০, ৭০ ও ৮০ এই তিন দশকে তিনি ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালীর ইলমী অঙ্গনের অন্যতম প্রধান অভিভাবক।

৭৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর দাফন হয় ওলামাবাজার মাদরাসা মসজিদের মিনারার পূর্ব পাশের মাকবারায়।

 

 

 

advertisement